উর্দু সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের মধ্যে অন্যতম হলেন মির্জা আসাদউল্লাহ খান গালিব। তিনি শুধু একজন কবি ছিলেন না, ছিলেন এক চিন্তাশীল, অনুভূতিপ্রবণ এবং গভীর জীবনদর্শনসম্পন্ন মানুষ। তার লেখা শুধু প্রেম, বিরহ বা দার্শনিক চিন্তা নয়, বরং সমাজ, ধর্ম, আত্মজ্ঞান ও অস্তিত্বের প্রশ্নগুলোও ছুঁয়ে যায় অনন্য রকমে।
গালিবের প্রতিটি কবিতা, চরণ, এমনকি তাঁর উক্তিগুলিও পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দেয়—কখনও প্রেমের অতল গভীরে, কখনও নিঃসঙ্গতার শূন্যতায়। এই উক্তিগুলো আমাদের ভাবায়, প্রশান্তি দেয় আবার কখনও জাগিয়ে তোলে এক বেদনাবোধ।
এখানে আপনি পাবেন:
মির্জা গালিবের উল্লেখযোগ্য উক্তিসমূহ (বাংলা অনুবাদ সহ)
“ভুলে যাবার আগে মনে রেখো:
মানুষ হওয়া সহজ, মানবিক হওয়া কঠিন।”
“ভবিষ্যতের চিন্তা নিয়ে অতীতের স্মৃতি এক আজাব:
হে আল্লাহ, আমার স্মৃতিশক্তি কেড়ে নাও!”
**”যদি এখানে কোনো ভাষাবিদ থাকে, তাকে ডেকে আনো —শহরে একজন অপরিচিত এসেছে,আর তার বলার মতো অনেক কিছু আছে।”
**”মসজিদে বসে মদ খেতে দাও,অথবা সেই জায়গাটা দেখাও যেখানে আল্লাহ নেই।”
**”ভালোবাসা চায় ধৈর্য, আকাঙ্ক্ষা চায় অস্থিরতা —হৃদয়কে কী রঙে রাঙাবো, যতক্ষণ না তুমি তাকে ছিন্নভিন্ন করো?”
**”যে প্রতিটি খণ্ডে সম্পূর্ণতা দেখতে পায় না,সে অন্ধকারে খেলছে।এক জ্ঞানী প্রতিটি চুমুকে টাইগ্রিস নদী স্বাদ নেয়।”
**”কান্না ও প্রেমে আমরা নির্লজ্জ হয়েছি,এমনভাবে ধুয়ে গেছি যেন পবিত্র হয়ে গেছি।”
(উর্দু গজল অনুবাদ)
**”এই পৃথিবী, যে প্রেমের নাম শুনে উজ্জ্বল হয়,এতটাই নিশ্চিত ভালোবাসা নিয়েযে আকাশও তার নিজের আলোকে অভিবাদন জানাতে নিচে নেমে আসে।”
**”জান্নাতে যদিও আমি সূর্যোদয়ের সময় কোরানে উল্লেখিত বিশুদ্ধ মদ পান করব,কিন্তু কোথায় পাবো সেই মাতাল বন্ধুদের সাথে রাতের হাঁটা,বা বর্ষার মাতাল ভিড়ের আনন্দ?”
**”পৃথিবী আমার চোখে বাচ্চাদের খেলার মাঠ,দিন-রাতের প্রতিটি ঘটনা কেবল এক প্রহসন মাত্র।”
**”সব কিছু সহজে চলে না,একজন মানুষ এমনকি মানুষ হওয়ার সামর্থ্যও রাখতে পারে না।”
**”সে আমাকে স্বর্গ ও পৃথিবী দিয়েছিল,ভেবেছিল আমি খুশি হবো;আসলে আমি বিতর্ক করতে লজ্জা পেয়েছিলাম।”
**”আমার উপাসনার বস্তু অনুভবের বাইরের জগতে —যারা দ্যাখে তাদের জন্য কাবা শুধুই একটি কম্পাস।”
**”আবার মন ছুটে যায় তোমার রাস্তায়!কিন্তু নিজেকে মনে করিয়ে দেই,সেখানেই তো হৃদয় হারিয়েছিলাম।”
**”চমৎকার ছিল এই প্রেম বাগানের প্রতি,কিন্তু এখন সেই ভালোবাসা নিজেই পাগলামি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
**”তোমার অনুপস্থিতির অলৌকিকতা এই যে,তোমাকে খুঁজে বেড়াতে বেড়াতে আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম।”
**”বিদায় ও পুনর্মিলনের মধ্যে একটি সুখ আছে —হাজার বার চলে যাও,তারপর দশ হাজার বার ফিরে এসো!”
(জার্মান ভাষায় বলা একটি কবিতা)
**”ঈর্ষা যদি হৃদয়কে বিষণ্ন করে তোলো,তবে দৃশ্যের মাঝে গা ভাসাও —হতে পারে, সংকীর্ণ চোখটি অপার সৌন্দর্যে প্রশস্ত হবে।”
(ফার্সি ভাষায়)
**”সম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষা আমাকে একটি দাসে পরিণত করেছে —নইলে আমি তো ঈশ্বর ছিলাম যদি আমার হৃদয় দাবি থেকে মুক্ত হতো।”
**”কষ্টে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়লে,কষ্ট আর কষ্ট থাকে না।এত কিছু চাপানো হয়েছে আমার উপর,যে এখন কঠিনতাও সহজ মনে হয়।”
(জার্মান ভাষায়)
**”কি আজব জীবন!একটা সন্ধ্যা কাটে না, অথচ দিব্যি বছর কেটে যায়।”
(মূলত বাংলা রচনায়)
“আহ’ কে একটা যুগ লাগে প্রভাব ফেলতে…”
**”আমি প্রেমিক, আর প্রতারণা আমার কাজ —লায়লা আমার সামনে মজনুকে খারাপ বলে।”
**”পুরোনো দিনের লোক এরা, কিছু বলো না —যারা মদ ও সঙ্গীতকে দুঃখজনক বলে।”
**”আকুলতা পর্যন্ত অভিযোগ করে হৃদয়ে —সমুদ্রের অস্থিরতা একটি মুক্তোয় আত্মস্থ হয়।”
মির্জা গালিবের বিখ্যাত উর্দু কবিতার বাংলা অনুবাদ
“আমরা জানি জান্নাত আসলে কী,
কিন্তু মনকে খুশি রাখতে এই ধারণাই ভালো।”
“তাঁর চেহারা দেখলেই মুখে আসে আলো,
তারা ভাবে, বুঝি রোগীর অবস্থাই ভালো!”
“ভালোবাসায় বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মধ্যে কোনো ফারাক নেই —
তাঁকে দেখেই বেঁচে আছি, যাঁর প্রেমেই প্রাণ ত্যাগ হবে একদিন।”
“রক্ত শিরায় ঘোরে — এ কথা আমি মানি না,
চোখ থেকেই না যদি ঝরে, তবে রক্তের মানে কী?”
“হাজারো আকাঙ্ক্ষা, প্রতিটি পূরণে প্রাণ ত্যাগের যোগ্য —
আমার অনেক স্বপ্ন ছিল, তবু মনে হয় তা যথেষ্ট ছিল না।”
“মানুষ যদি দুঃখের অভ্যস্ত হয়ে যায়,
তবে দুঃখ আর থাকে না দুঃখ।
আমার উপর এত কষ্ট পড়েছে যে সবই সহজ হয়ে গেছে।”
“এই দুনিয়ায় অনেক ভালো কবি আছেন,
কিন্তু বলে যে, গালিবের প্রকাশভঙ্গিই আলাদা।”
“আমার কপালে ছিল না প্রিয়জনের মিলন,
যদি আর কিছুদিন বাঁচতাম, শুধু অপেক্ষাই করতাম।”
“কাবার দিকে কোন মুখ নিয়ে যাবে গালিব?
লজ্জা তো তোমার হয় না!”
“কিছু ছিল না, তখন ছিল ঈশ্বর —
আর কিছু না থাকলেও ঈশ্বর থাকতেন।
আমাকে ডুবিয়েছে এই ‘অস্তিত্ব’,
যদি আমি না-হি থাকতাম, তবে কী হতো?”
“আমার হৃদয়ে তোমার অর্ধেক টানা তীরটি নিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করুক —
এই কাঁটার ব্যথা কোথা থেকে, যদি তা পুরোপুরি বুক ভেদ করত?”
“একটি বিন্দুর সুখ, মহাসাগরে বিলীন হয়ে যাওয়া —
যখন ব্যথা সীমা ছাড়ায়, তখন তা-ই হয়ে ওঠে ওষুধ।”
“আহ’–এর প্রভাব দেখাতে লাগে এক জীবনকাল,
কে বেঁচে থাকে তোমার কেশ গাঁথার শেষ অবধি?”
“ধারে মদ খেতাম, ভাবতাম একদিন
আমার এই দারিদ্র্যই এনে দেবে রঙিন দিন!”
“প্রত্যেক কাজের সহজ সমাধান দুষ্কর —
মানুষ তো দূরের কথা,
মানুষ হয়ে ওঠাটাও সহজ নয়।”
“এই পৃথিবী আমার চোখে শিশুদের খেলার মাঠ —
দিনরাত চলে কেবল এক নাট্যমঞ্চের প্রদর্শনী।”
“মদের দোকানের দরজার কোথায় আমি আর কোথায় সে ধর্মপ্রচারক!
শুধু জানি, গতকাল যখন সে গেল, তখন আমি বেরিয়ে এসেছি।”
“ব্যথা ওষুধে নির্ভর করল না —
আমি ভালোও হইনি, খারাপও হইনি।”
উপসংহার
মির্জা গালিবের বাণীগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সাহিত্য কেবল ভাষার অলংকার নয়—এটি এক গভীর আত্মঅন্বেষণের পথ। তার প্রতিটি উক্তি যেন জীবনের কোনো না কোনো গভীর সত্যের অনুবাদ। ভালোবাসা, বেদনা, সময়, ঈশ্বর কিংবা আত্মপরিচয়—সব কিছুকে তিনি নিজের শব্দে এতটাই মোহনীয় করে তুলেছেন যে তা শতাব্দী পেরিয়ে আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
এই উক্তিগুলো আমাদের শেখায় কীভাবে মানুষ হয়েও মানবিক থাকা যায়, কীভাবে ভালোবাসা আর বিরহের ভেতরেও সৌন্দর্য খোঁজা যায়। গালিবের সাহিত্য তাই কেবল ইতিহাস নয়—এটি চিরন্তন অনুভবের ভাষ্য।

