রোমান্টিক গল্প শুধু হৃদয়ের অনুভূতি নয়, এটি ভালোবাসার নীরব ভাষা, সম্পর্কের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন, আর হৃদয়ছোঁয়া মুহূর্তের স্মৃতিচারণ। জীবনের প্রতিটি বাঁকে, কোথাও না কোথাও প্রেম লুকিয়ে থাকে—কখনো বন্ধুত্বের মোড়কে, কখনো হঠাৎ দেখা কোনো অপরিচিত মুখে, আবার কখনো দীর্ঘ অপেক্ষার একপাক্ষিক ভালোবাসায়।
এই গল্পগুলো আমাদের ভাবায়, হাসায়, চোখে জল এনে দেয়—আর শেখায়, ভালোবাসা কখনোই নিখোঁজ হয় না, শুধু অপেক্ষা করে সঠিক সময়ের। এই আর্টিকেলে আমরা তুলে ধরব কিছু হৃদয়স্পর্শী ও বাস্তবতাসম্পন্ন রোমান্টিক গল্প, যেগুলো পাঠকের মনে ছাপ ফেলবেই।
এখানে আপনি পাবেন:
রোমান্টিক গল্প ১: বৃষ্টিভেজা বিকেলে তোমায়
বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ। আকাশের কোণে জমে থাকা কালো মেঘগুলো যেন কারো অপ্রকাশিত অভিমান নিয়ে নেমে এসেছে শহরের গায়ে। রাস্তার পাশে ছোট্ট কফির দোকানটা আজ কিছুটা বেশি ভিড় জমিয়েছে। সবাই আশ্রয় নিতে এসেছে, কেউ বৃষ্টির থেকে, কেউ একাকিত্বের থেকে। কিন্তু এক কোণে বসে থাকা আরাফাতের চোখ বারবার দরজার দিকে। সে কারো জন্য অপেক্ষা করছে — তিথির।
আরাফাত ২৬ বছরের এক তরুণ, পেশায় গ্রাফিক ডিজাইনার। কিন্তু আজ তার হাতে কোনো ল্যাপটপ নেই, কোনো প্রজেক্ট ফাইল নেই, শুধু এক কাপ কফি আর এক অজানা অস্থিরতা। তিথি তার জীবনে এসেছিল হঠাৎ করেই, প্রায় দুই বছর আগে, এক অফিস প্রজেক্টে। প্রথম দিনেই তিথির সেই সহজ হাসি, চোখে অদ্ভুত গভীরতা, আর কথা বলার মিষ্টি ভঙ্গিটা আরাফাতকে অবচেতনেই টেনে নিয়েছিল।
তাদের সম্পর্কের শুরুটা ছিল একদম সাধারণ, অথচ মায়ায় ভরা। একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়া, অফিসের ছাদে বৃষ্টিতে ভিজে গল্প করা, কাজ শেষে এক কাপ কফি ভাগাভাগি করা — এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোতেই যেন জন্ম নিল এক নিঃশব্দ ভালোবাসা। তারা কেউ কাউকে কিছু বলেনি, কিন্তু দু’জনেই জানত, তাদের মধ্যে কিছু একটার জন্ম হয়েছে, যা কেবল কাজের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
একদিন বিকেলে তিথি হালকা গলায় বলেছিল, “আরাফাত, তুমি কখনো ভেবেছো, কিছু মানুষ আমাদের জীবনে আসে ঠিক গল্পের মতো?” আরাফাত একটু হেসে বলেছিল, “আর কিছু গল্প এমনও হয়, যেখানে আমরা বুঝতেই পারি না কোনটা শুরু আর কোনটা শেষ।” তিথি চুপ করে তাকিয়ে ছিল তার চোখে, আর সেই মুহূর্তটা যেন সময়ের মধ্যে জমে গিয়েছিল — এক নিঃশব্দ ভালোবাসার স্বীকারোক্তি, যা মুখে বলা হয়নি, কিন্তু অনুভবে ছেয়ে গিয়েছিল চারপাশ।
কিন্তু জীবনের গল্পগুলো সবসময় সহজ হয় না। একদিন হঠাৎ একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হলো তাদের মধ্যে। তিথি ভেবেছিল, আরাফাতের জীবনে হয়তো অন্য কেউ আছে। এক বন্ধুর মুখে ভুল তথ্য শুনে তার মনে সন্দেহের বীজ বপন হলো। আরাফাত বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তিথি মুখ ফিরিয়ে নিল। তাদের গল্প থেমে গেল এক অনুচ্চারিত কষ্টের জায়গায়। এক শহরে থেকেও তারা একে অপরের খবর রাখা বন্ধ করে দিল। বৃষ্টি পড়ত, কিন্তু সেই বৃষ্টিতে আর “তুমি” ছিলে না।
দু’বছর কেটে গেল। আজ, সেই একই বৃষ্টিভেজা বিকেলে, হঠাৎ তিথির মেসেজ এল — “বিকেলে কফির দোকানে আসবে? কিছু কথা বলতে চাই।” আরাফাত প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি, কিন্তু অবশেষে এসেছে, বসে আছে সেই পুরনো কফিশপের কোণে, এক কাপ কফি ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। হালকা নীল শাড়িতে, ভেজা চুলে, চোখে পুরনো আলো নিয়ে তিথি ভেতরে ঢুকল। আরাফাতের মনে হলো, সময় হঠাৎ থেমে গেছে। তিথি হেসে বলল, “তুমি এখনো কফি ঠিক আগের মতোই ধীরে খাও।” আরাফাতও মৃদু হেসে বলল, “আর তুমি এখনো ঠিক আগের মতোই দেরি করো।” দু’জনেই হেসে উঠল, আর সেই হাসিতে যেন গত দুই বছরের সব অভিমান ধুয়ে গেল বৃষ্টির জলে।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর তিথি নিচু স্বরে বলল, “আরাফাত, আমি ভুল করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তোমার জীবনে কেউ আছে, কিন্তু পরে বুঝেছি আমি শুধু নিজের ভয়েই হারিয়ে গিয়েছিলাম।” আরাফাত তাকিয়ে রইল তার দিকে, তারপর শান্ত গলায় বলল, “আমিও চেষ্টা করেছিলাম তোমাকে ভুলে যেতে, কিন্তু পারিনি তিথি। প্রতিটা ডিজাইনে, প্রতিটা ছবিতে তোমার মুখটাই ফুটে উঠত। আমি তো শুধু তোমাকেই আঁকতাম…”
বাইরে তখন বৃষ্টি আরও জোরে পড়ছে। দোকানের কাঁচ বেয়ে জলবিন্দুগুলো নামছে ধীরে ধীরে। তিথি হাত বাড়িয়ে ধরল আরাফাতের হাত। তার চোখে জল চিকচিক করছে, কিন্তু ঠোঁটে একরাশ স্বস্তির হাসি। “আমরা কি আবার শুরু করতে পারি?” সে জিজ্ঞেস করল। আরাফাত কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে রইল তার চোখে, যেখানে সে দেখল নিজের পুরনো ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি।
কফির দোকান থেকে বেরিয়ে তারা হাঁটছিল একসাথে, একটাই ছাতার নিচে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মিশে যাচ্ছিল তাদের হাসির সঙ্গে। তিথি ধীরে বলল, “জানো, আজ আমি আর ভয় পাইনি।” আরাফাত হেসে উত্তর দিল, “ভালোবাসা মানেই তো ভয় না, তিথি। সেটা সাহস — আবার হাত ধরা, আবার শুরু করার সাহস।”
বৃষ্টির শেষে আকাশ পরিষ্কার হলো, সূর্যের আলো মিশে গেল ভেজা রাস্তায়। শহরটা যেন নতুন করে জেগে উঠল, আর তাদের গল্পও শুরু হলো আবার — নতুন অধ্যায়ে, আগের ভালোবাসার সুরে।
শেষে শুধু বলা যায় — কিছু গল্পের সমাপ্তি হয় না। তারা ফিরে আসে অন্য কোনো বিকেলে, অন্য কোনো বৃষ্টিতে, ঠিক তখনই যখন দুইটি মন আবার সাহস করে একে অপরের দিকে তাকায়।
রোমান্টিক গল্প ২: শেষ বিকেলের আলো
সূর্যটা তখন আস্তে আস্তে ঢলে পড়ছে পশ্চিমে। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় ভিড় একটু কমে এসেছে, আর নরম কমলা রোদ মিশে যাচ্ছে ধূসর বিল্ডিংয়ের কাচে। ঠিক সেই সময়টা — যখন দিন আর রাতের মাঝখানে একটা শান্ত, কোমল ফাঁক তৈরি হয় — তখনই তিথির চোখে পড়ে আরিয়ানকে।
আরিয়ান বসে আছে কলেজের পুরনো বেঞ্চে, হাতে একটা পুরনো নোটবুক। তিথি থমকে দাঁড়াল। সেই নোটবুকটা সে চিনে — এটা তাদের দুজনেরই, যেখানে তারা একসাথে কবিতা লিখত, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে গল্প করত, ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনত। কিন্তু এখন, সবকিছুই কেবল স্মৃতি।
তাদের দেখা হয়েছিল পাঁচ বছর আগে, কলেজের প্রথম দিনে। তিথি নতুন, চুপচাপ মেয়েটি, আর আরিয়ান ছিল ব্যাচের সবচেয়ে প্রাণবন্ত ছেলেটা। প্রথম দিনেই আরিয়ান হেসে বলেছিল, “তুমি হাসলে পুরো ক্লাসরুমটা আলো হয়ে যাবে।” তিথি হেসে কিছু বলেনি, কিন্তু সেই হাসিই ছিল তাদের গল্পের শুরু।
দিন কেটে গিয়েছিল, বন্ধুত্ব বদলে গিয়েছিল ভালোবাসায়। তারা একসাথে ক্যান্টিনে কফি খেত, ক্লাস শেষে বইমেলায় যেত, আর চুপিচুপি কলেজের ছাদে বসে তারা দেখত। তখন মনে হতো, পৃথিবীটা হয়তো খুব ছোট — শুধু তারা দু’জনেই এর ভেতর।
কিন্তু জীবনের গল্পগুলো সবসময় সরল হয় না। তিথির পরিবার খুব রক্ষণশীল, আরিয়ান ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। তিথির বাবা-মা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল — “ভালোবাসা দিয়ে সংসার হয় না।” তিথি প্রতিবাদ করেছিল, কেঁদেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছিল। একদিন তিথি চলে গেল কলকাতায়, উচ্চশিক্ষার জন্য। কোনো বিদায় নয়, কোনো কথা নয়। শুধু একখানা চিঠি — “যদি ভালোবাসা সত্যি হয়, সময় আমাদের ফের মিলিয়ে দেবে।”
বছর দুয়েক পর তারা যোগাযোগ হারিয়ে ফেলল। আরিয়ান চাকরির খোঁজে ব্যস্ত হয়ে গেল, তিথি নতুন শহরের জীবনে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামলে তিথি ছাদে উঠে তাকাত আকাশের দিকে, মনে মনে বলত — “আরিয়ান, তুমি কি এখনো কবিতা লেখো?”
আজ, এতদিন পর, তারা আবার মুখোমুখি। হঠাৎ যেন সময় থেমে গেছে। তিথি ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, বলল, “তুমি এখনো এখানে বসো?” আরিয়ান মাথা নিচু করে হেসে বলল, “হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আসি। তোমার সাথে যে জায়গাটা সবচেয়ে বেশি গল্প বলেছিল, সেটা ফেলে যেতে পারিনি।”
তিথি চুপ করে বসে পড়ল পাশে। বাতাসে একটা অচেনা গন্ধ — মিশে আছে পুরনো ভালোবাসা আর অজানা অপরাধবোধ। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিথি বলল, “জানো, আমি ভেবেছিলাম সময় তোমায় ভুলিয়ে দেবে।”
আরিয়ান উত্তর দিল না, শুধু বলল, “সময় কিছু মানুষকে ভুলিয়ে দেয় না, শুধু শেখায় কীভাবে তাদের ছাড়া বাঁচতে হয়।”
তিথির চোখে জল এসে গেল। সে ধীরে বলল, “আমি তোমায় কষ্ট দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি চেয়েছিলাম তুমি ভালো থাকো।”
আরিয়ান তাকিয়ে বলল, “তুমি কি জানো, আমি ভালো থাকতে শিখেছিলাম ঠিক তোমার হাসি মনে রেখেই।”
তারা দুজনেই চুপ করে রইল। সূর্যটা তখন প্রায় ডুবে গেছে। রোদটা লালচে হয়ে পড়ছে, যেন আকাশটাও বিদায় জানাচ্ছে তাদের পুরনো গল্পকে। তিথি বলল, “তুমি এখন কেমন আছ?”
আরিয়ান হেসে বলল, “বাঁচি… যেমন গল্পগুলো বাঁচে শেষ পৃষ্ঠা ছিঁড়ে যাওয়ার পরও।”
বাতাসে তখন হালকা শীত, গাছের পাতায় আলো ঝিকমিক করছে। তিথি হাত বাড়িয়ে রাখল বেঞ্চের উপর। আরিয়ান ধীরে ধীরে নিজের হাত রাখল তার পাশে, কিন্তু ছোঁয়নি — শুধু দুটো হাতের মাঝখানে ছিল কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব, ঠিক যেমনটা তাদের জীবনে এখন।
তিথি বলল, “যদি সেই চিঠিটা আবার লিখতে পারতাম, লিখতাম — ‘আমি থাকতাম।’”
আরিয়ান একটু থেমে বলল, “আর আমি লিখতাম — ‘আমি অপেক্ষা করব।’”
সূর্য ডুবে গেল পুরোপুরি। চারদিক অন্ধকার, কিন্তু তাদের চোখে অদ্ভুত এক আলো। বিদায় নেওয়ার সময় তিথি বলল, “আমরা আবার দেখা করব, হয়তো অন্য কোনো শহরে, অন্য কোনো সময়।”
আরিয়ান মৃদু স্বরে বলল, “যদি ভালোবাসা সত্যি হয়, সময় আমাদের ফের মিলিয়ে দেবে — ঠিক যেমন তুমি লিখেছিলে।”
তিথি চলে গেল। আরিয়ান চুপচাপ তাকিয়ে রইল, আকাশের দিকে। তার নোটবুকের শেষ পাতায় লেখা ছিল —
“কিছু গল্প অসম্পূর্ণ থাকলেই সুন্দর,
কারণ তাতে অপেক্ষার আলো থাকে।”
রোমান্টিক গল্প ২: চাঁদের আলোয় তুমি
রাতটা ছিল অদ্ভুত শান্ত। শহরের আলো নিভে যাওয়ার পর আকাশের দিকে তাকালে শুধু একটা পূর্ণচাঁদ দেখা যাচ্ছিল — উজ্জ্বল, একা, অথচ অচেনাভাবে সুন্দর। ঠিক এমন রাতেই আরহাম প্রথম দেখেছিল মেহরীনকে।
সেটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মেহরীন গাইছিল মঞ্চে — রবীন্দ্রসংগীত, “তুমি রবে নীরবে।” দর্শকভরা অডিটোরিয়ামে আরহাম হঠাৎ নিজেকে খুঁজে পেল সেই গানের সুরের ভেতর। মেহরীনের কণ্ঠে ছিল এক ধরনের কোমলতা, যেন প্রতিটা শব্দ হৃদয়ে নরমভাবে গেঁথে যায়। সে জানত না, গানটা শেষ হওয়ার আগেই তার গল্প শুরু হয়ে গেছে।
অনুষ্ঠান শেষে আরহাম ভিড় ঠেলে বাইরে এল, কিন্তু মেহরীনকে খুঁজে পেল না। তার মনে হলো, সে যেন একটুখানি আলো দেখেছিল, তারপর সেটি মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। সেদিন থেকেই মেহরীন তার মনে জায়গা করে নিল — অচেনা এক নামহীন ভালোবাসার মতো।
দিন গড়াতে লাগল। কয়েক সপ্তাহ পর, বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে হঠাৎ আবার দেখা। মেহরীন টেবিলের এক কোণে বসে বই পড়ছিল। আরহাম সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেল।
“তুমি মঞ্চে গান গেয়েছিলে, তাই না?”
মেহরীন মুখ তুলে তাকাল, একটু অবাক হলেও হাসল। “হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কিভাবে মনে রাখলে?”
আরহাম হেসে বলল, “যে গান মন ছুঁয়ে যায়, সেটা ভুলে যাওয়া যায় না।”
সেই দিন থেকেই তাদের বন্ধুত্ব শুরু। ক্লাস শেষে একসাথে হাঁটা, লাইব্রেরিতে বই খোঁজা, ক্যাম্পাসের চা স্টলে গল্প — ধীরে ধীরে বন্ধুত্বের ভিতর একটা অনুচ্চারিত অনুভূতি গড়ে উঠল।
মেহরীন ছিল প্রাণবন্ত, চঞ্চল মেয়ে। তার হাসিতে ছিল জীবনের সহজ আনন্দ, আর আরহাম ছিল একটু শান্ত, চিন্তাশীল প্রকৃতির। কিন্তু তাদের দু’জনের মধ্যে এক অদ্ভুত মিল ছিল — দুজনেই একা থাকলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসত।
একদিন সন্ধ্যায়, ক্যাম্পাসের ছাদে বসে তারা চাঁদ দেখছিল। হালকা বাতাস বইছে, মেহরীন বলল, “জানো, চাঁদটাকে আমি খুব হিংসে করি।”
আরহাম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “হিংসে? কেন?”
মেহরীন হেসে বলল, “কারণ চাঁদ কখনো কারো হয় না, তবু সবাই ওকে ভালোবাসে।”
আরহাম একটু চুপ করে থেকে বলল, “কিন্তু কিছু ভালোবাসা অধিকার চায় না, শুধু থেকে যাওয়াই যথেষ্ট।”
সেই রাতেই তারা বুঝল, কিছু সম্পর্কের নাম দেওয়া যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায় প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
কিন্তু জীবনের গল্পে মোড় আসে হঠাৎই। মেহরীনের বাবা বিদেশে চাকরি পেয়ে পরিবার নিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সে খবর শুনে আরহামের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। শেষ দিনে তারা আবার ছাদে দেখা করল, ঠিক সেই চাঁদের নিচে।
মেহরীন বলল, “আমি যাচ্ছি, হয়তো অনেকদিনের জন্য। জানি না ফিরে আসব কি না।”
আরহাম কিছু বলল না। সে শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন কথা বলছে চাঁদের সঙ্গে। তারপর ধীরে বলল, “যদি কখনো চাঁদ দেখো, মনে করো আমি তাকিয়ে আছি একই আকাশের নিচে।”
মেহরীন চোখ মুছে বলল, “আর তুমি যদি চাঁদ দেখো, মনে করো কেউ তোমার জন্য গান গাইছে দূরে কোথাও।”
তারপর সে চলে গেল। বিমানের জানালার পাশে বসে মেহরীন শেষবারের মতো তাকিয়েছিল নিচে ঝলমল করা শহরের দিকে। কোথাও একজন মানুষ হয়তো তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল — ঠিক একই চাঁদের নিচে।
সময় গড়াল। তিন বছর পর, এক বর্ষার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আরহামের পুরনো বন্ধুরা মিলনমেলা আয়োজন করল। আরহাম গেল — কিছুটা অনিচ্ছা, কিছুটা কৌতূহল নিয়ে। হঠাৎ ভিড়ের মাঝখানে সে শুনল একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর — রবীন্দ্রসংগীত, “তুমি রবে নীরবে।”
সে ঘুরে তাকাল। মঞ্চে মেহরীন দাঁড়িয়ে, তিন বছর পর, ঠিক আগের মতোই, শুধু একটু বেশি শান্ত। গান শেষ হওয়ার পর তাদের চোখে চোখ পড়ল। কেউ কিছু বলল না, শুধু একে অপরের হাসিতে ফিরে এল হারানো সময়।
রাতটা আবারও চাঁদের। মেহরীন বলল, “তুমি এখনো চাঁদ দেখো?”
আরহাম হেসে বলল, “দেখি, কারণ জানতাম একদিন ওর আলোয় তোমাকে আবার পাব।”
তারা হাঁটছিল একসাথে, ধীরে ধীরে, চাঁদের আলোয় ভেজা রাস্তায়। সব অভিমান, সব দূরত্ব যেন গলে গেল সেই আলোয়। কিছু ভালোবাসা হারায় না, শুধু ঘুরে ফিরে আসে, ঠিক তখনই যখন তুমি তা সবচেয়ে কম আশা করো।
ভালোবাসার রোমান্টিক গল্প ৩: তোমার চোখে সকাল
সকালটা ছিল অদ্ভুত সুন্দর। জানলার ফাঁক দিয়ে হালকা রোদ এসে পড়েছিল তামান্নার মুখে। চোখ খুলে সে প্রথমেই দেখল — পাশের টেবিলে এক কাপ কফি আর একটা ছোট্ট নোট, যেখানে লেখা —
“ঘুম ভাঙলে হাসো, কারণ তোমার হাসিটাই আমার সকাল।”
নোটটা লিখেছিল রিদয়। দুই বছর হলো তাদের বিবাহিত জীবন, তবু প্রতিটি সকাল যেন নতুন এক শুরু। ভালোবাসা তাদের জীবনে এখনো প্রথম দিনের মতো সতেজ। কিন্তু এই গল্পের শুরুটা এতটা মসৃণ ছিল না।
তাদের দেখা হয়েছিল একেবারে অদ্ভুতভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপ প্রজেক্টে তামান্না ছিল সিরিয়াস আর পারফেকশনিস্ট, আর রিদয় ছিল একদম উল্টো — হাসিখুশি, নির্ভার, মজার ছলে সব কাজ করত। শুরুতে তাদের মধ্যে একেবারেই মিল ছিল না। তামান্না রাগ করে বলত, “তুমি এত অসচেতন কেন?” আর রিদয় হাসত, “তুমি এত চিন্তা করো কেন?”
তবে প্রতিবার তর্কের মধ্যেও এক অদ্ভুত টান ছিল। একদিন গ্রুপের সবাই অনুপস্থিত, শুধু তারা দু’জন। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ, আর রিদয় জানলার পাশে দাঁড়িয়ে হালকা গলায় বলল, “তুমি জানো, বৃষ্টি মানুষকে কাছাকাছি আনে?”
তামান্না হেসে বলল, “সবাই তা ভাবে, কিন্তু বৃষ্টি শেষ হলে সবাই আবার নিজের মতো হয়ে যায়।”
রিদয় চুপ করে রইল, তারপর বলল, “তাহলে আমি এমন কাউকে খুঁজব, যার সঙ্গে বৃষ্টি শেষে রোদও ভাগাভাগি করতে পারি।”
সেই কথাটা তামান্নার মনে গেঁথে গিয়েছিল। এরপর থেকে তাদের সম্পর্কের ভেতরে আস্তে আস্তে গড়ে উঠল এক অজানা উষ্ণতা। রিদয়ের অগোছালো হাসি, তামান্নার মনোযোগী চোখ — দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ একে অপরের মধ্যে খুঁজে পেল নিজের অসম্পূর্ণ অংশ।
একদিন তামান্না রিদয়কে বলল, “তুমি জানো, তোমার মতো মানুষ আমি আগে দেখিনি।”
রিদয় বলল, “আমি জানি, কারণ তোমার মতো মানুষ কেউ হতে পারে না।”
সেই কথার পর তারা দু’জনেই চুপ করেছিল, কিন্তু বাতাসের ভেতর ভালোবাসার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল।
দিন গড়াতে লাগল। তারা একে অপরের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠল। কিন্তু জীবনের পথ সবসময় মসৃণ নয়। তামান্নার বাবা-মা রিদয়কে মেনে নিতে পারেননি — কারণ সে তখনও স্থায়ী চাকরি পায়নি।
তামান্না দ্বিধায় পড়ে গেল। সে ভালোবাসত রিদয়কে, কিন্তু পরিবারের সম্মানও রাখতে চাইছিল।
রিদয় তখন একদিন তাকে বলল, “আমি চাই না তুমি তোমার পরিবারকে ছেড়ে যাও। আমি শুধু চাই তুমি বিশ্বাস করো — আমি তোমার জন্য লড়ব।”
তারপর শুরু হলো এক বাস্তব সংগ্রাম। রিদয় দিন-রাত পরিশ্রম করল, নিজের ব্যবসা শুরু করল ছোট পরিসরে। সময় লাগল, কিন্তু সে পেরে উঠল। এক বছর পর, এক বিকেলে, তামান্নার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রিদয় বলল, “এবার আমি এসেছি শুধু তোমাকে ভালোবাসতে নয়, তোমার পরিবারকেও জিততে।”
তামান্নার বাবা অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলেন। তারপর বলেছিলেন, “ভালোবাসা যদি এত ধৈর্য শেখায়, তবে সেটা সত্যিই পবিত্র।”
সেই দিনেই তামান্না ও রিদয়ের সম্পর্ক স্বীকৃতি পেল। তাদের বিয়ে হলো, কোনো আড়ম্বর নয় — কিন্তু একদম সত্যিকারের ভালোবাসার আশীর্বাদে।
আজ দুই বছর পরও, রিদয় প্রতিদিন সকালে তামান্নার জন্য কফি বানায়, আর ছোট ছোট নোট লিখে রাখে। তাদের জীবনে ঝগড়া আছে, অভিমান আছে, কিন্তু আছে সেই ভালোবাসাও, যা বৃষ্টির দিনে জন্ম নিয়ে রোদে পরিণত হয়েছিল।
একদিন তামান্না রাতে রিদয়কে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি কখনো ভেবেছিলে আমরা এতটা দূর আসব?”
রিদয় হেসে বলল, “আমি শুধু ভেবেছিলাম, তুমি থাকলেই পথটা সুন্দর হবে। বাকিটা জানতাম না।”
তামান্না তাকিয়ে রইল তার দিকে। বাইরে তখন পূর্ণচাঁদ উঠেছে, জানলার পর্দা হালকা দুলছে।
তার মনে হলো, ভালোবাসা মানে ঠিক এই—
কারো পাশে বসে নীরবতা ভাগাভাগি করা, আর মনে মনে বলা—
“তুমি থাকলে, প্রতিটা সকালই নতুন।”
রোমান্টিক গল্প ৪: “তোমায় ছুঁয়ে থাকা নীরবতা”
রাতটা ছিল অদ্ভুত শান্ত। চারপাশে হালকা বাতাস, বারান্দার গাছগুলো দুলছে মৃদু শব্দে। নীলার চোখে ঘুম নেই — হাতে ধরা একটা পুরনো খাম, যার ভেতরে রয়েছে কিছু চিঠি, হলদে কাগজে লেখা। প্রতিটি চিঠির শেষে এক নাম — “আরাফ”।
আরাফের সঙ্গে নীলার গল্পটা শুরু হয়েছিল একদম সহজভাবে, অথচ সেই সরলতার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল গভীরতা। তারা দু’জনেই একই কলেজে পড়ত, কিন্তু ভিন্ন দুনিয়ার মানুষ। নীলা ছিল শান্ত, অন্তর্মুখী, বই আর গানেই মগ্ন। আরাফ ছিল প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, আর সবসময় মানুষের ভিড়ে ঘেরা।
তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনীতে। নীলা ছবি আঁকছিল, আরাফ গিটার বাজাচ্ছিল পাশে। হঠাৎ বাতাসে নীলার আঁকা ক্যানভাস উড়ে গিয়ে পড়ল তার গিটারের সামনে। ছবিটা দেখে আরাফ থমকে গেল — সেটি ছিল ঠিক তার নিজের মুখের মতো!
আরাফ হেসে বলেছিল, “তুমি কি আমার ছবি এঁকেছো?”
নীলা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলেছিল, “না, কল্পনায় একটা মুখ এঁকেছিলাম। হয়তো কাকতালীয়।”
আরাফের চোখে মৃদু হাসি। সে বলেছিল, “তাহলে বুঝি আমি তোমার কল্পনার মানুষ!”
সেই এক মুহূর্তেই শুরু হয়েছিল তাদের গল্প।
দিন গড়াতে গড়াতে তাদের মধ্যে তৈরি হলো বন্ধুত্ব, তারপর ধীরে ধীরে সেই বন্ধুত্ব বদলে গেল ভালোবাসায়। তারা একসাথে বই পড়ত, কফি খেত, শহরের ভেতর ঘুরে বেড়াত, আর আকাশে চাঁদ দেখত — কারণ নীলা চাঁদ ভালোবাসত, আরাফ বলত, “চাঁদটা তোমার মতো — আলো ছড়ায় কিন্তু নরমভাবে।”
তবে ভালোবাসা যত সুন্দরই হোক, বাস্তবতা ততই কঠিন। নীলার পরিবার খুব রক্ষণশীল ছিল। তারা চায়নি সে “শিল্পী ছেলের” সঙ্গে মেশুক। আরাফ বারবার চেষ্টা করেছে প্রমাণ করতে — তার ভালোবাসা সৎ, কিন্তু নীলার বাবা-মা শুধু বলেছিল, “ভালোবাসা দিয়ে সংসার চলে না।”
একদিন বিকেলে নীলা বলেছিল, “যদি কখনো আমরা একসাথে না থাকতে পারি, তবু তুমি গান থামিও না, আরাফ। কারণ তোমার গানে আমি বেঁচে থাকব।”
আরাফ হাসেনি। শুধু বলেছিল, “তুমি যদি চলে যাও, আমার গানের প্রতিটা সুর তোমার নামেই কাঁদবে।”
তারপর সেই দিন এল — নীলা শহর ছেড়ে চলে গেল। একটাও বিদায়ের শব্দ নয়, শুধু একটা চিঠি রেখে গেল —
“ভালোবাসা আমার, কিন্তু সময়টা তোমার নয়।”
বছর দুই কেটে গেল। আরাফ গান গাওয়া বন্ধ করে দিল। মঞ্চের আলো, দর্শক, সব ছেড়ে নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল সে। তার কণ্ঠে জমে রইল অগণিত অসমাপ্ত গান, যার প্রতিটিতে ছিল নীলার নাম।
একদিন হঠাৎ এক অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো — কলেজের রিইউনিয়ন। অনেক দ্বিধা নিয়ে সে গেল। গিটার হাতে মঞ্চে উঠল, কিন্তু গান শুরু করার আগেই চোখে পড়ল এক মুখ — নীলা।
সে চুপচাপ বসে আছে প্রথম সারিতে, হাতে একটি ছোট্ট ফুল। চোখে অশ্রু, ঠোঁটে নরম হাসি।
আরাফের কণ্ঠ কেঁপে উঠল, তারপর সে গান শুরু করল —
“তুমি যেখানেই থাকো, আমার সুরে রবে…”
পুরো হল নিস্তব্ধ। শুধু গিটারের তারে বেজে চলেছে তাদের অসমাপ্ত ভালোবাসা।
গান শেষে নীলা ধীরে এগিয়ে এলো। দু’জনের চোখে চোখ পড়ল — সেই নীরবতা, সেই অনুভব, যা কখনো মরে যায় না।
নীলা বলল, “আমি ভেবেছিলাম, তোমার গান থেমে যাবে।”
আরাফ মৃদু হেসে উত্তর দিল, “থেমে গিয়েছিল, কিন্তু তুমি ফিরে আসার জন্যই হয়তো আজ আবার গাইতে পারলাম।”
তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল, অনেকক্ষণ। কোনো প্রতিশ্রুতি নয়, কোনো নাটকীয়তা নয় — শুধু একটা গভীর বোঝাপড়া, যা ভালোবাসার থেকেও বেশি।
রাতটা তখন চাঁদে ভরা। হলের বাইরে বেরিয়ে নীলা বলল, “চাঁদটা দেখো, এখনো আগের মতো সুন্দর।”
আরাফ হেসে বলল, “হ্যাঁ, তবে এবার তার আলোয় তুমি আছো।”
বাতাসে তখন একটা অদ্ভুত শান্তি। দু’জন হাঁটছিল পাশাপাশি, কোনো কথা না বলেও সব বলা হয়ে যাচ্ছিল। হয়তো তারা একসাথে থাকবে, হয়তো না — কিন্তু সেই মুহূর্তে তারা জানত, ভালোবাসা ঠিক এই নীরবতাতেই বেঁচে থাকে।
রোমান্টিক গল্প ৫: “অপেক্ষা”
রাত্রির শেষ প্রহরে যখন শহর নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখনও রুদ্রর চোখে ঘুম আসে না। তার ডেস্কে পড়ে থাকে পুরনো একটি নীল খাম—যেটির উপরে এখনো স্পষ্ট লেখা: “তোমার অপেক্ষায় – মীরা”। এই নামটা এখন তার হৃদয়ের গভীরে কেবল স্মৃতি হয়ে আছে। কিন্তু স্মৃতি কখনো কখনো বাস্তব থেকেও বেশি জ্যান্ত হয়।
ছয় বছর আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির করিডোরে প্রথম দেখা হয় রুদ্র আর মীরার। মীরা ছিল চঞ্চল, প্রাণবন্ত, অথচ গভীরভাবে চিন্তাশীল; আর রুদ্র ছিল নীরব, লাজুক, বই আর কফির গন্ধে ডুবে থাকা এক ছেলে। দুইজন দুই মেরুর মানুষ, কিন্তু কোনো এক অলিখিত সূত্রে যেন তাদের চোখের ভাষায় জন্ম নেয় এক অপূর্ব টান।
প্রথমদিকে কিছুই স্পষ্ট ছিল না—কেবল সময় কাটানো, বইয়ের পৃষ্ঠা ভাগাভাগি, আর একসঙ্গে হাঁটা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মাঝের বন্ধন গভীর হতে থাকে। মীরা একদিন বলেছিল, “রুদ্র, আমি তোমার মতো কাউকে কখনো কল্পনাও করিনি।” রুদ্র তখনো কিছু বলেনি—শুধু মুচকি হেসেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষের আগমুহূর্তে হঠাৎই মীরার পরিবার তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয় উচ্চশিক্ষার জন্য। যাওয়ার আগে সে রুদ্রকে একটি চিঠি দিয়েছিল—সেই নীল খাম। তাতে লেখা ছিল,
“আমি জানি, আমরা কখনো বলিনি ভালোবাসি, কিন্তু আমি অপেক্ষা করব—তুমি যদি সত্যিই আমায় চাও, একদিন এসে দাঁড়াবে আমার সামনে।”
রুদ্র চিঠি পড়ে ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু তার পরিবার, দারিদ্র্য আর বাস্তবতা তখন তার পায়ে শিকল বেঁধে রেখেছিল। সে কখনো মীরাকে বলেনি, “তোমাকেই আমি চাই”—এই না বলার কষ্টই ছিল সবচেয়ে বড় বোঝা।
বছর চলে যায়, রুদ্র ঢাকায় একটি চাকরিতে ঢোকে, নিজেকে ব্যস্ত রাখে, কিন্তু মীরার চিঠিটা তার ডেস্কেই পড়ে থাকে—প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়, “তুমি কিছু বলোনি…”
আজ এত বছর পর হঠাৎ এক বন্ধুর মাধ্যমে রুদ্র জানতে পারে, মীরা দেশে ফিরেছে, তবে এখনো অবিবাহিত। রুদ্র জানে, সময় চলে গেছে, কিন্তু অনুভব আজও আটকে আছে সেই করিডোরে। তাই সে এক সন্ধ্যায় হঠাৎ দাঁড়ায় মীরার বাড়ির সামনে, হাতে সেই পুরনো নীল খাম।
মীরা দরজা খুলে চমকে ওঠে, চোখে জল, ঠোঁটে একটুকরো হাসি।
রুদ্র ধীরে বলে, “তুমি বলেছিলে অপেক্ষা করবে… আমি দেরি করে ফেলেছি, কিন্তু যদি এখনো সুযোগ দাও, তবে এইবার আমি কোনো চিঠি নয়, চোখের ভাষায় নয়—সরাসরি বলব, আমি তোমায় ভালোবাসি।”
মীরা কিছু বলে না। শুধু এগিয়ে আসে, রুদ্রর হাতে রাখা খামটি নিয়ে নিজের বুকের কাছে চেপে ধরে। আর এই নিঃশব্দ মুহূর্তেই, তারা বুঝে যায়—ভালোবাসা কখনো ফুরায় না, যদি কেউ সত্যিকার অর্থে অপেক্ষা করে।
গল্পের শিক্ষা:
ভালোবাসা শুধুই কথায় নয়, অপেক্ষায়ও প্রকাশ পায়। সত্যিকারের ভালোবাসা সময়ের পরীক্ষা পেরিয়ে একদিন ঠিকই ফিরে আসে তার প্রিয় মানুষের কাছে।
রোমান্টিক গল্প ৬: “হঠাৎ দেখা”
নীরব এক সন্ধ্যায় ঢাকার ব্যস্ততম মোড়ের পাশে ছোট্ট এক কফি শপে বসে ছিল আয়ান। ছাদের ওপরে ঝিম ধরে থাকা আকাশটা যেন তার মনকে অনুকরণ করছিল—ঘোলাটে, ভারী, বোঝা কঠিন। সে জানত না কেন আজ এই জায়গায় এসে বসেছে। হয়তো ক্লান্ত মন কিছু পুরনো স্মৃতির পাশে একটু নির্ভার হতে চেয়েছে।
এই শহরটাতেই তো সে একসময় তৃষার সঙ্গে প্রতিটি সন্ধ্যা ভাগ করেছিল। তৃষা—তার জীবনের সবচেয়ে অপ্রকাশিত ভালোবাসার নাম। তারা একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পড়েছিল, একসঙ্গে গান শুনেছে, বৃষ্টিতে ভিজেছে, একে অপরের চোখে হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কখনো কেউ কারো কাছে ভালোবাসার কথা বলেনি।
কারণ সময়টা তখন “পরীক্ষার”, “ক্যারিয়ারের”, “পারিবারিক দায়িত্বের”—আর প্রেম? সেটা ছিল একটা অচেনা আবেগ, যেটা দুজনেই চেপে রেখেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষের কিছুদিন পর তৃষা হঠাৎ হারিয়ে যায় আয়ানের জীবন থেকে। যোগাযোগ বন্ধ, মেসেজের উত্তর নেই, এমনকি বন্ধুবান্ধবরাও জানত না সে কোথায়। আয়ান প্রথমে রাগ করেছিল, পরে দুশ্চিন্তা, তারপর অভিমান… তারপর নীরবতা। ধীরে ধীরে আয়ান নিজের জীবন গুছিয়ে নেয়, একটা কর্পোরেট অফিসে জব, ব্যস্ত সকাল আর ক্লান্ত সন্ধ্যা।
তবে আজ এত বছর পর, এই কফিশপে বসে হঠাৎ করেই তার দৃষ্টি পড়ে দরজার দিকে—সাদা শাল গায়ে, বই হাতে, তৃষা দাঁড়িয়ে।
দুজনের চোখ আটকে যায়। সময় থেমে যায়।
তৃষা এগিয়ে আসে, হাসে, আর বলে, “হয়তো তোমারই দেখা পাওয়ার জন্য আজ এতদিন পর এখানে আসা…”
আয়ান কিছু বলতে পারে না। শুধু তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণের নীরবতার পর তৃষা বলে,
“আমি হারিয়ে যাইনি আয়ান, আমি শুধু তখন সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরিবারের চাপে, নিজের অনিশ্চয়তায়। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার কথা কোনোদিন ভুলিনি।”
আয়ান এবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
“আমিও তো কখনো কাউকে তোমার মতো ভালোবাসতে পারিনি।”
কফির কাপ ঠান্ডা হয়, কিন্তু তাদের মাঝখানের আবেগ আবার উষ্ণ হতে থাকে।
সেই রাতটা দুজনের জন্য যেন সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুনর্জন্ম। পুরনো না বলা ভালোবাসা আবার শব্দ খুঁজে পায়।
হ্যাঁ, এই গল্পটা “হঠাৎ দেখা”র, কিন্তু মূলত এটি সেই ভালোবাসার, যেটি কখনো মরে না—শুধু অপেক্ষা করে, সঠিক সময়ের।
গল্পের বার্তা:
ভালোবাসা কখনো কখনো দূরে সরে যায়, কিন্তু যদি তা সত্যি হয়—একদিন ঠিকই ফিরে আসে। আর যখন ফিরে আসে, তখন চোখে চোখ রেখে বলা যায়—”তুমি ছিলে, আছো, থাকবেই।”
রোমান্টিক গল্প ৭: “তুমি না হলে…”
সেই ক্লাস সেভেন থেকে শুরু। নিশাত আর রিদয়—দুইজনই একই স্কুলে পড়ে, পাশাপাশি বেঞ্চে বসে। দিনের শুরুটা ছিল “তুই হোমওয়ার্ক করিস নাই?” দিয়ে, আর শেষ হতো “চল আজ আইসক্রিম খেতে যাই” দিয়ে। কারও কেউ ছিল না, অথচ ওরা ছিল একে অপরের ছায়া। বন্ধুরা বলত, “তোমরা প্রেম করো?” ওরা হেসে উড়িয়ে দিত।
কিন্তু সময় বদলায়। স্কুল শেষ হয়, কলেজে ভর্তি, নতুন বন্ধু, নতুন পরিবেশ—তবুও নিশাত আর রিদয়ের বন্ধুত্ব অটুট থাকে। প্রতিদিন কথা না হলে যেন দিনটাই অসম্পূর্ণ লাগে। নিশাতের মন খারাপ হলে সে কারও সাথে না, শুধুমাত্র রিদয়ের সাথেই খোলাখুলি কথা বলত। রিদয়ও তার প্রতিটি সিদ্ধান্তে নিশাতকে পাশে চাইত।
তারা নিজেরাও টের পায়নি—কখন জানো বন্ধুত্বটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আর সেই অভ্যাসটাই ছিল আসলে ভালোবাসার ছদ্মবেশ।
একদিন হঠাৎ নিশাত অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে ভর্তি—জ্বর, ইনফেকশন, দুর্বলতা। রিদয় তার চাকরির ইন্টারভিউ বাদ দিয়ে হাসপাতালের বাইরে বসে রাত কাটিয়ে দেয়। নিশাত জানত না। যখন সে সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন রিদয় কিছু না বলে একটা ছোট্ট চিরকুট দিয়ে যায়। তাতে লেখা—
“আমি জানি না এটা প্রেম কিনা, কিন্তু আমি জানি—তুমি না থাকলে আমার সকালটা শুরু হয় না, রাতটা শেষ হয় না। তুমি না হলে আমি আমি থাকি না।”
নিশাত চুপ করে কাগজটা পড়ে, চোখে জল আসে। কারণ ওর মনেও ঠিক একই অনুভূতি ছিল—শুধু বলা হয়নি।
সেই দিনই হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিশাত রিদয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,
“তুই যদি এটা প্রেম না বলিস, তাহলে আমি বলছি—হ্যাঁ রিদয়, আমি তোকে ভালোবাসি।”
আর এই সরল স্বীকারোক্তির মধ্যেই ওদের বন্ধুত্ব মিশে যায় প্রেমের গভীরতায়।
আজ তারা দুই সন্তানের বাবা-মা। ভালোবাসার শুরুটা বন্ধুত্ব হলেও, বন্ধুত্বটাই তাদের ভালোবাসার সবচেয়ে মজবুত ভিত।
গল্পের শিক্ষা:
ভালোবাসা সব সময় তীব্র উত্তেজনা বা নাটকীয় আবেগে শুরু হয় না। অনেক সময় তা গড়ে ওঠে দিনের পর দিন পাশে থাকায়, নীরব বুঝিয়ে দেওয়ায়, আর একে অপরের জীবনে অবিচ্ছেদ্য হয়ে যাওয়ায়। প্রেম তখনই নিখুঁত হয়, যখন তা বন্ধুত্বের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।
রোমান্টিক গল্প ৮: “মেঘবরণ সকাল”
সেদিনটা ছিল একেবারে সাধারণ—আকাশে হালকা মেঘ, মাঝে মাঝে রোদ চোখে ঝিলিক দিচ্ছে। তুলি ব্যস্ত ছিল বইমেলা ঘুরতে। তার ব্যাগ ভর্তি নতুন বই, চোখে সানগ্লাস, কানে হেডফোন। অথচ তার ভেতরটা ছিল খালি—সম্প্রতি একটা দীর্ঘ সম্পর্ক ভেঙে গেছে। তুলি কারও ওপর রাগ করছিল না, কেবল নিজেকেই প্রশ্ন করছিল, “আমি কি সত্যিই ভালোবাসার যোগ্য?”
এমন সময়েই ঘটনাটা ঘটে। ভিড়ের ভেতর হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় তুলি। আর একজোড়া হাত তাকে তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলে—একজন ছেলে, চোখে চশমা, হাতে বইয়ের ব্যাগ। সে বলল,
“আপনি ঠিক আছেন?”
তুলির মুখে বিরক্তি, কিন্তু ছেলেটির চোখে ছিল এক অদ্ভুত শান্তি।
তুলি শুধু বলল, “ধন্যবাদ” এবং হাঁটতে লাগল।
কিন্তু কাকতালীয়ভাবে সেই ছেলেটির নাম ছিল আদিব, এবং তারা একই স্টলে বই দেখছিল। চোখাচোখি হতে থাকল বারবার। আদিব হালকা হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে বলল,
“এই লেখকের বই আপনি পড়েন?”
তুলি প্রথমে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার মনে হলো—এই ছেলেটি যেন তার মনের অনেক না বলা কথাগুলো বোঝে।
তারা বসে চা খেল, বই নিয়ে কথা বলল, সিনেমা নিয়ে তর্ক করল, আর অনুভব করল—দুইজনের ভেতর কিছু একটা তৈরি হচ্ছে। অথচ তুলি স্পষ্ট বলেছিল,
“আমি কারো প্রেমে জড়াতে চাই না এখন।”
আদিব মৃদু হেসে বলেছিল,
“ঠিক আছে। প্রেম না হোক, ভালো একটা বন্ধুত্ব হোক না। দেখা যাক, ভাগ্য কোথায় নেয়।”
এরপর দেখা হতে লাগল কিছুদিন পর পর—একসঙ্গে বই পড়া, বৃষ্টিতে হাঁটা, সিনেমার ট্রেইলার নিয়ে বিতর্ক, আর একে অপরের ক্লান্ত দুপুরে ছোট্ট একটা ফোন কল। তুলি একদিন বুঝে ফেলে—আদিব ধীরে ধীরে তার ভেতরের শূন্যতা পূর্ণ করে দিচ্ছে। সে ভাঙা ছিল, কিন্তু আদিব কখনো জোড়া লাগাতে আসেনি—শুধু পাশে থেকেছে।
এক সন্ধ্যায় তুলি বলল,
“তুই জানিস, আমি তোকে কখনই ভালোবাসতে চাইনি…”
আদিব চুপচাপ তাকিয়ে ছিল তার দিকে।
তুলি ধীরে হেসে বলল,
“কিন্তু তোর চুপ থাকা, তোর পাশে থাকা, সব কিছু আমাকে বাধ্য করল তোকে ভালোবেসে ফেলতে।”
আদিবের চোখে তখন মেঘ জমেছিল। সে বলল,
“তুই শুধু বলতে দেরি করেছিস, আমি তো তোর জন্য অনেক আগেই অপেক্ষা করছিলাম—ঠিক বইমেলার সেই প্রথম দিনে থেকে।”
গল্পের শিক্ষা:
ভালোবাসা সব সময় পরিকল্পিতভাবে আসে না। কখনো কখনো তা হুট করেই চলে আসে—একটা হোঁচটে, একটা হাসিতে, একটা গল্পে। কিন্তু যখন আসে, তখন বুঝিয়ে দেয়—এটাই সত্যিকারের, কারণ এটা কোনো দাবি ছাড়াই শুধু পাশে থাকতে জানে।
বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর রোমান্টিক গল্প
রাতের ঘড়িতে তখন ১১টা বাজে। রান্নাঘরে এখনো আলো জ্বলছে। রায়ান চুপচাপ টেবিলে বসে কিছু একটা লিখছে, আর রান্নাঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে হালকা গানের সুর।
সেই সুরের উৎস — মেহজাবিন।
মেহজাবিন আর রায়ানের বিয়ে হয়েছে ছয় মাস।
দু’জনেই ব্যস্ত মানুষ — রায়ান কাজ করে এক বিজ্ঞাপনী সংস্থায়, আর মেহজাবিন স্কুলের শিক্ষক। কিন্তু এই ব্যস্ততার মাঝেও তারা প্রতিদিন একটু সময় রাখে শুধুমাত্র দু’জনের জন্য — এক কাপ চা, একসাথে বসে দিনের গল্প করা, অথবা নিঃশব্দে একে অপরের চোখে তাকানো।
আজও তেমনই এক রাত।
মেহজাবিন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো, হাতে গরম দুধের কাপ।
“তুমি এখনো কাজ করছ?” — সে জিজ্ঞেস করল।
রায়ান হাসল, “না, তোমার জন্য কিছু লিখছি।”
মেহজাবিন অবাক, “লিখছো? কী লিখছো?”
রায়ান বলল, “চিঠি।”
“চিঠি? কিন্তু তুমি তো আমার সামনেই আছো!”
রায়ান মুচকি হেসে বলল, “তবু চিঠি লিখছি, কারণ কখনো কখনো অনুভূতি বলার চেয়ে লিখে রাখা ভালো লাগে।”
মেহজাবিন চুপ করে তার পাশে বসে পড়ল। জানালার বাইরে বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ।
এই ছোট্ট মুহূর্তগুলোতেই তাদের সংসারটা বেঁচে আছে — ঝগড়ার মধ্যেও ভালোবাসা, নীরবতার মধ্যেও মায়া।
বিয়ের আগে তাদের সম্পর্ক ছিল না। এটা ছিল পরিবারের পছন্দের বিয়ে।
প্রথম দিকে মেহজাবিন ভয় পেত — একজন অচেনা মানুষকে ভালোবাসা যায় কি?
কিন্তু রায়ান তার সেই ভয়কে ধীরে ধীরে ভালোবাসায় বদলে দিয়েছে।
সকালে যখন সে স্কুলে যায়, রায়ান টেবিলে ছোট একটা নোট রেখে যায় —
“আজও হাসবে, কারণ তোমার হাসিটাই আমার সৌভাগ্য।”
আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তারা একসাথে বসে সিনেমা দেখে, বা গল্প করে।
তারা এখনো একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করছে, কিন্তু প্রতিদিন একটু একটু করে একে অপরের ভেতরে আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে।
একদিন মেহজাবিন হঠাৎ বলল,
“তুমি জানো, আমি কখনো ভাবিনি ভালোবাসা এত সহজ হতে পারে।”
রায়ান জিজ্ঞেস করল, “সহজ?”
মেহজাবিন হেসে বলল, “হ্যাঁ, কারণ তুমি কখনো ভালোবাসাকে জোর করো না। তুমি শুধু উপস্থিত থাকো — সেটাই যথেষ্ট।”
রায়ান চুপ করে তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে।
তার চোখে তখন ঘরভরা শান্তি।
কিন্তু একদিন তাদের ছোট্ট এই পৃথিবীতে হালকা ঝড় এলো।
রায়ানের অফিসে অতিরিক্ত কাজের চাপ, রাতে দেরি করে ফেরা, আর মেহজাবিনের মনে অভিমান জমা হতে লাগল।
এক রাতে রায়ান ফিরে দেখে, মেহজাবিন কিচেনের টেবিলে বসে আছে, মুখে নীরবতা।
“তুমি আবার অপেক্ষা করছ?” রায়ান জিজ্ঞেস করল।
মেহজাবিন বলল, “তুমি এখন কফির থেকেও ব্যস্ত হয়ে গেছ।”
রায়ান কিছু বলল না। ধীরে কাছে গিয়ে তার হাত ধরল।
“হ্যাঁ, আমি ব্যস্ত… কিন্তু তোমার কথাই ভাবতে ভাবতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। জানো, এই ব্যস্ততাই আমাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনে।”
মেহজাবিনের চোখে জল চলে এলো।
সে বলল, “তুমি জানো, আমি অভিমান করতে শিখেছি তোমার কারণেই, আর মানতেও শিখেছি তোমার কারণেই।”
রায়ান হাসল, “তাহলে আমরা ঠিক আছি।”
তারপর তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।
বাইরে তখন বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে, কিন্তু ঘরের ভেতরটা ভরে আছে উষ্ণতায়।
রাত শেষে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে রায়ান মেহজাবিনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি কি জানো, প্রতিদিন তোমাকে নতুন করে ভালোবাসা যায়?”
মেহজাবিন চোখ বন্ধ করে বলল, “তুমি কি জানো, আমি প্রতিদিন নতুনভাবে তোমার প্রেমে পড়ি?”
সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল — ভালোবাসা মানে বড় কোনো কথা নয়,
এটা হলো প্রতিদিন একসাথে থাকা, একে অপরের শ্বাসে মিশে যাওয়া,
আর নীরবে বুঝে ফেলা — “এই মানুষটাই আমার ঘর।”
ইসলামিক রোমান্টিক গল্প: আল্লাহর লিখে রাখা ভালোবাসা
রাতের আকাশে চাঁদ আধখানা। হালকা বাতাসে গাছের পাতা দুলছে ধীরে ধীরে, মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসছে আজানের সুর। নামাজ শেষে আরহাম মসজিদের সিঁড়িতে বসে ছিল। তার মুখে প্রশান্তি, কিন্তু মনে যেন এক অদ্ভুত অস্থিরতা। আজকাল একটা নাম, একটা মুখ বারবার ঘুরে ফিরে আসে তার চিন্তায় — মেহরিন।
তিন মাস আগে, বৃষ্টির পরের এক বিকেলে, অফিস থেকে ফেরার পথে সে দেখেছিল এক মেয়ে — সাধারণ পোশাকে, মাথায় শাল, হাতে ছাতা। মেয়েটি রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধা মহিলাকে সাহায্য করছিল রাস্তা পার করাতে। ভেজা বাতাসে তার কণ্ঠের কোমলতা যেন অন্যরকম লাগছিল। “চলুন আম্মা, আস্তে হাঁটুন,” — এই একটুকু বাক্যই যেন আরহামের মনে গেঁথে গেল। তার চেহারা তখন পুরোপুরি দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু সেই আচরণে ছিল একরাশ বিনয় আর ঈমানের আলো।
আরহাম অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল, যতক্ষণ না রিকশাটা দূরে চলে যায়। মনে হচ্ছিল, এই মেয়েটি আলাদা — যেন নামাজের পরের শান্তি মিশে আছে তার চোখে। বাড়ি ফিরে সে বুঝল না কেন, কিন্তু মেহরিন নামটা তার হৃদয়ের ভেতর একটা অচেনা অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে।
এরপর থেকে মাঝে মাঝে সেই রাস্তায় যেত আরহাম, আশা করত হয়তো আবার দেখা হবে। কিন্তু প্রতিবারই ফিরে আসতে হতো হতাশ হয়ে। একদিন মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বলল, “হুজুর, যদি কোনো মেয়ের প্রতি ভালো অনুভূতি হয়, কিন্তু হালালভাবে পৌঁছানো না যায়, তাহলে কী করা উচিত?” ইমাম মৃদু হেসে বলেছিলেন, “তুমি নামাজে দোয়া করো। যদি সে তোমার জন্য আল্লাহর লিখে রাখা হয়, তবে তিনি নিজেই তার রাস্তা খুলে দেবেন।”
সেই দিন থেকে আরহাম প্রতিরাতে তাহাজ্জুদের নামাজে দোয়া করতে লাগল। সিজদায় গিয়ে বলত, “হে আল্লাহ, যদি সে আমার জন্য লেখা থাকে, তাহলে হালালভাবে আমার জীবনে এনে দাও।” তার প্রতিটি প্রার্থনায় মেহরিনের নাম ছিল, কিন্তু মুখে কখনো উচ্চারণ করেনি।
একদিন হঠাৎ তার ছোট বোন বলল, “ভাইয়া, আমাদের স্কুলে নতুন শিক্ষক এসেছেন, মেহরিন ম্যাম! উনি খুব ভালো মানুষ, কুরআনের আয়াত দিয়ে বোঝান কিভাবে প্রতিটা কাজ ইবাদত হতে পারে।” সেই নাম শুনে আরহামের বুক ধক করে উঠল। সে গেল বোনকে আনতে, আর সেদিনই তার চোখে পড়ল মেহরিন — সেই একই মেয়ে, যাকে বৃষ্টির দিনে দেখেছিল।
দু’জনের চোখে চোখ পড়ল, মেহরিন সালাম দিল, আরহাম উত্তর দিল — “ওয়া আলাইকুমুস সালাম।” মুহূর্তটা ছিল নিঃশব্দ, কিন্তু সেই নীরবতার মধ্যেই আল্লাহর পরিকল্পনা লুকিয়ে ছিল। কয়েক সপ্তাহ পর, আরহাম পরিবারের মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠাল। মেহরিনের পরিবার প্রথমে অবাক হলেও খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, আরহাম নামাজি, পরিশ্রমী ও সৎ মানুষ। কোনো গোপন সম্পর্ক ছিল না, ছিল শুধু এক পবিত্র দোয়া এবং আল্লাহর ইচ্ছা।
দুই মাস পর তাদের নিকাহ সম্পন্ন হলো। বিয়ের রাতে মেহরিন নরম গলায় বলল, “আমি সবসময় আল্লাহকে বলতাম, যদি কেউ আমার জীবনে আসে, সে যেন আমাকে জান্নাতের পথে এগিয়ে দেয়।” আরহাম হাসল, “আমি চাই না তুমি শুধু আমার স্ত্রী হও, আমি চাই তুমি আমার জান্নাতের সঙ্গী হও।”
বিয়ের পর তাদের ভালোবাসা ছিল একদম আলাদা। সকালে ফজরের নামাজ শেষে তারা একসাথে কুরআন পড়ত, রাতে ঘুমানোর আগে একে অপরের জন্য দোয়া করত। মাঝে মাঝে মেহরিন বলত, “তুমি জানো, হালাল ভালোবাসা মানে শুধু একসাথে থাকা নয়; একে অপরকে আল্লাহর পথে টেনে নেওয়া।” আর আরহাম হাসত, “তুমি আমার সবচেয়ে সুন্দর দোয়া, যা কবুল হয়েছে।”
এক রাতে বৃষ্টির সময় তারা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। মেহরিন বলল, “তুমি জানো, আমি প্রথম যেদিন তোমাকে দেখেছিলাম, ভাবছিলাম — এই মানুষটা নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে দোয়া করে।” আরহাম চোখে তাকিয়ে বলল, “তাহলে বুঝি আমাদের দু’জনের দোয়াগুলো একসাথে কবুল হয়েছে।”
বৃষ্টি থেমে গেল, আকাশে উঠল উজ্জ্বল চাঁদ। তারা দুজন একসাথে তাকিয়ে রইল — সেই একই চাঁদের দিকে, যেটি একদিন দূর থেকে তাদের দেখেছিল। আজ সেই চাঁদের আলোয় তারা একত্রে, হালাল ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধা।
সেই রাতের নীরবতায় মেহরিন ধীরে বলল, “যে ভালোবাসা আল্লাহর জন্য, তার কোনো শেষ নেই।”
আর আরহাম উত্তর দিল, “কারণ আল্লাহর লিখে রাখা ভালোবাসা কখনো হারায় না, শুধু সময়মতো ফিরে আসে।”
শেষের উক্তি:
“যে ভালোবাসা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়, তা শুধু দুনিয়ায় নয় — জান্নাতেও একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়।”
উপসংহার
ভালোবাসার গল্পগুলো আমাদের শেখায়—জীবনের প্রতিটি সম্পর্কই সময়, অনুভব এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এই রোমান্টিক গল্পগুলো কেবল কল্পনার নয়; বরং বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি, যেখান থেকে আমরা অনুপ্রেরণা পাই, হারানো বিশ্বাস ফিরে পাই, আর অনুভব করি ভালোবাসার সত্যিকারের রূপ। আপনি যদি প্রেম, সম্পর্ক ও মানবিক অনুভূতির গভীরতায় ডুব দিতে চান, তাহলে এ ধরনের রোমান্টিক গল্পগুলো আপনার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। মনে রাখবেন, জীবনের যেকোনো মুহূর্তেই ভালোবাসা এসে যেতে পারে—প্রয়োজন শুধু একটি খোলা হৃদয় আর বোঝার মন।

