কবর কবিতা সম্পূর্ণ | জসীম উদ্দিন

By Ayan

Published on:

বাংলা কবিতার ইতিহাসে “কবর” শুধু একটি কবিতা নয় – এটি গ্রামীণ জীবনের হৃদয়ছোঁয়া এক বর্ণনামূলক মহাকাব্য। কবি জসীমউদ্দীন, যিনি “পল্লীকবি” নামে পরিচিত, তাঁর এই কবিতায় একজন বৃদ্ধ দাদুর কণ্ঠে জীবনের সমস্ত হারানো সম্পর্ক, মৃত্যু ও স্মৃতির বেদনা তুলে ধরেছেন। এটি তাঁর “সুচয়নী” কাব্যগ্রন্থের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা।

কবর কবিতা

জসীমউদ্দীন

এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল লইয়া খেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।

বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।
শাপলার হাটে তরমুজ বেচি দু’পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!
হেস না- হেস না- শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!
নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।
আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়!
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়,
আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।

তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে লাগায়ে বুক,
আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।

এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,
কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।
সেই ফালগুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি,
বা-জান, আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি।
ঘরের মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও,
সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কী জানিত কেউ?
গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,
তুমি যে কহিলা বা-জানেরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?
তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!

তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জড়ায়ে ধরি,
তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিত সারা দিনমান ভরি।
গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেতো ঝরে,
ফালগুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।
পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ,
চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।
আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।

ঊদাসিনী সেই পল্লী-বালার নয়নের জল বুঝি,
কবর দেশের আন্ধার ঘরে পথ পেয়েছিল খুঁজি।
তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ,
হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ।
মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, বাছারে যাই,
বড় ব্যথা র’ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষ্মী আমার ওরে,
কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।
ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গন্ড ভিজায়ে নয়ন-জলে,
কী জানি আশিস করে গেল তোরে মরণ-ব্যথার ছলে।

ক্ষণপরে মোরে ডাকিয়া কহিল- আমার কবর গায়
স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।
সেই সে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,
পরাণের ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।
জোড়-মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু-ছায়,
গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়।
জোনাকি-মেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,
ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, রহমান খোদা! আয়;
ভেস্ত নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়!

এইখানে তোর বু-জীর কবর, পরীর মতন মেয়ে,
বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের ঘরে বনিয়াদি ঘর পেয়ে।
এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে,
হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।
খবরের পর খবর পাঠাত, দাদু যেন কাল এসে
দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।
শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে
অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।
সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি,
কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি।
বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন,
কে জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণ-বীণ!
কী জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে,
এইখানে তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে।

ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো,
কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।
বনের ঘুঘুরা উঁহু উঁহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,
পাতায় পাতায় কেঁপে ওঠে যেন তারি বেদনার বীণ।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়।
আমার বু-জীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।

হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু, সাত বছরের মেয়ে,
রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।
ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা,
অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা!
ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,
তোমার দাদির ছবিখানি মোর হদয়ে উঠিত ছেয়ে।
বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,
রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।

একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,
ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।
সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে।
কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।
আপন হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি,
দাদু! ধর- ধর- বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।
এইখানে এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু,
কথা কস নাকো, জাগিয়া উঠিবে ঘুম-ভোলা মোর যাদু।
আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে,
দীন দুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে !

ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূর।
জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত প্রাণ।

কবিতার সারাংশ (Summary)

“এইখানে তোর দাদির কবর ডালিমগাছের তলে”—এই পঙক্তি দিয়েই শুরু হয় বেদনার এক স্রোতধারা।
দাদু তাঁর নাতিকে কবর দেখাতে গিয়ে ধীরে ধীরে তার দাদি, বাপ, মা, বুজি ও ছোট ফুপু—এইসব প্রিয়জনের কবরের কথা বলতে থাকেন।
প্রত্যেকটি কবর একেকটি জীবনের গল্প, যেখানে ভালোবাসা, মৃত্যু, বেদনা ও স্নেহ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
শেষে দাদুর নিজের জীবনও যেন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়—“ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে”—এই পঙক্তিতেই কবিতাটি চিরবিরহের অন্ধকারে ঢলে পড়ে।

“কবর” কবিতার বিস্তারিত সারাংশ

জসীমউদ্দীনের “কবর” কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম হৃদয়স্পর্শী পল্লী-কাব্য। এই কবিতায় কবি এক বৃদ্ধ দাদুর মুখে জীবনের করুণ ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। দাদু তাঁর নাতিকে নিয়ে গ্রামের একটি নির্জন কবরস্থানে যান—যেখানে তাঁর পরিবারের সকল প্রিয়জনের কবর একে একে সাজানো। কবরগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নাতিকে শোনাতে শুরু করেন নিজের জীবনের গল্প, যা আসলে গ্রামীণ জীবনের এক অনন্ত শোকগাথা।


দাদির কবর থেকে শুরু

কবিতার শুরুতেই দাদু নাতিকে বলেন—

“এইখানে তোর দাদির কবর ডালিমগাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।”

এই লাইন থেকেই বোঝা যায়, তাঁর জীবনের গভীরতম বেদনা শুরু হয়েছে দাদির মৃত্যু দিয়ে। দাদুর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে যৌবনের ভালোবাসা, নববধূর মুখ, সংসারের হাসি-কান্না, আর গ্রামীণ জীবনের সরল আনন্দ।
তিনি মনে করেন, দাদির মতো সোনামুখ মেয়ে তাঁর ঘরে ছিল এক আশীর্বাদ; পুতুলের বিয়েতে মন ভেঙে কাঁদা সেই কিশোরী বধূ আজ মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে।
দাদু বলেন—দাদির মৃত্যু তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। সেই থেকে যেন সব আনন্দ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।


বাপ-মায়ের কবর ও পারিবারিক বেদনাধারা

দাদু এরপর নাতিকে দেখান—

“এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা।”

এই অংশটি কবিতার সবচেয়ে বেদনাময় অধ্যায়।
দাদু স্মরণ করেন, ফাল্গুন মাসের এক সকালে তাঁর ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি জানতেও পারেননি যে, সেটিই ছিল তাঁর সন্তানের শেষ দিন।
ছেলেকে কফনে মুড়িয়ে কবর দিতে গিয়ে নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান।
“তুমি যে কহিলা বা-জানেরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?” —এই লাইনটি পুরো কবিতার সবচেয়ে করুণ মুহূর্ত।
মৃত্যুর কঠিন বাস্তবতা এখানে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।

তাঁর বউমা (নাতির মা) ছিলেন স্নেহময়ী ও পরিশ্রমী নারী।
ছেলের মৃত্যুর পর তিনি প্রতিদিন কাঁদতেন, মাঠের বলদগুলো পর্যন্ত সেই কান্নায় সাড়া দিত।

“গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেতো ঝরে,
ফালগুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।”

এই চিত্রগুলো শুধু ব্যক্তিগত শোক নয়—পুরো প্রকৃতিই যেন দুঃখে অংশ নেয়।

শেষে নাতির মা-ও মারা যান। মৃত্যুর আগে ছেলেকে (অর্থাৎ দাদুকে) বলেন—

“আমার কবর গায় স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।”
এই অনুরোধে এক গ্রামীণ নারীর ভালোবাসা, ধর্মবিশ্বাস ও সংসারমমতা একসাথে ধরা দেয়।


বুজির করুণ মৃত্যু

এরপর দাদু নাতিকে নিয়ে যান তাঁর প্রিয় বু-জির (মেয়ে) কবরের সামনে।
তিনি বলেন, বুজি ছিল পরীর মতো সুন্দর। তাকে বিবাহ দিয়েছিলেন “কাজিদের ঘরে”—এক ধনী পরিবারে। কিন্তু সেখানে মেয়েটি ভালোবাসা পায়নি, কষ্টে দিন কাটাত।
বাবার বাড়ি যেতে চেয়ে খবর পাঠাত, আর একসময় পচানো জ্বরে মারা যায়।
দাদুর মুখে কষ্টমিশ্রিত অনুশোচনা ফুটে ওঠে—তিনি মেয়েকে সময়মতো রক্ষা করতে পারেননি।


ছোট ফুপুর অকাল মৃত্যু

শেষে দাদু নাতিকে দেখান তাঁর ছোট ফুপুর কবর, যে মাত্র সাত বছরের মেয়ে ছিল।
দাদু বলেন, মেয়েটির মুখে দাদির ছায়া ছিল।
একদিন হাটে যাওয়ার সময় তিনি তাকে বাড়িতে রেখে যান; ফিরে এসে দেখেন,

“সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।”
সাপের দংশনে সে মারা গেছে।
দাদু নিজ হাতে তাকে কবর দেন, বুক ফেটে কান্নায় ভেঙে পড়েন—
“দাদু! ধর-ধর- বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।”

এই মুহূর্তে পাঠকও অনুভব করে, দাদুর আর কিছু হারানোর বাকি নেই—সব প্রিয়জন মাটির তলায় ঘুমিয়ে।


শেষ দৃশ্য: জীবনের রোজ কেয়ামত

কবিতার শেষে সূর্য ডুবে যায়, সন্ধ্যা নামে বনের ওপারে।
দাদু অনুভব করেন, তাঁর নিজের জীবনও শেষের পথে।

“ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।”

মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসে, যা মৃত্যুর আহ্বান নয়—বরং এক চিরন্তন মুক্তির সঙ্গীত
দাদু নাতিকে বলেন,

“জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা রহমান,
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত প্রাণ।”

এই প্রার্থনাতেই কবিতার সমাপ্তি। মৃত্যু যেন আর ভয় নয়—বরং শান্তি, পরিত্রাণ ও মিলনের প্রতীক।


সারসংক্ষেপে

“কবর” কবিতাটি একটি বৃদ্ধ দাদুর জীবনের প্রতিচ্ছবি হলেও, এটি আসলে সমগ্র মানবজীবনের প্রতীকী গল্প
প্রত্যেক মানুষের জীবনে প্রিয়জনের হারানোর ব্যথা, মৃত্যুর অনিবার্যতা এবং ভালোবাসার স্মৃতি মিশে থাকে।
জসীমউদ্দীন অত্যন্ত সরল ভাষায় আমাদের শেখান—

“মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে লাগায়ে বুক।”
এই লাইনেই লুকিয়ে আছে কবিতার মূল দর্শন:
জীবন মাটির মতো—দুঃখে-আনন্দে ভরা, তবুও সে-ই আমাদের চির আশ্রয়।


আরও পড়ুন: কবর নিয়ে স্ট্যাটাস

কবিতার বিষয়বস্তু ও বার্তা (Themes & Message)

১. মৃত্যু ও জীবনের সম্পর্ক:
কবি দেখিয়েছেন, মৃত্যু কোনো বিচ্ছেদ নয়—এটি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দাদুর চোখ দিয়ে আমরা দেখি, ভালোবাসা ও মৃত্যু একসঙ্গে বেঁচে থাকে।

২. গ্রামীণ আবহ ও বাস্তবতা:
জসীমউদ্দীন তাঁর স্বাভাবিক ভাষায় গ্রামীণ জীবনের ছবি এঁকেছেন। মাঠ, ডালিমগাছ, হাট, তামাক, মাজন—সবকিছু এত বাস্তব যে পাঠক যেন গ্রামের সেই মাটিতেই পৌঁছে যায়।

৩. ভালোবাসা ও মমতা:
প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে দাদুর সম্পর্ক গভীর স্নেহে ভরা। দাদির প্রতি ভালোবাসা, বাপ-মায়ের প্রতি মমতা, বুজির প্রতি দুঃখ—সব মিলিয়ে কবিতাটি হয়ে উঠেছে মানবিক আবেগের উৎসব।

৪. দারিদ্র্য ও ভাগ্যের নির্মমতা:
কবিতার মানুষগুলো সুখ পায় না। তাদের জীবন দুঃখে জর্জরিত, তবু তারা মাটির সঙ্গে মিশে এক অনন্য শান্তি খুঁজে পায়।


ভাষা ও শৈলী বিশ্লেষণ

  • কবিতার ভাষা সরল, গ্রামীণ, অথচ গভীর দার্শনিক
  • “ডালিমগাছ”, “মাজন”, “তামাক” —এই শব্দগুলো কবিতাকে লোকজ ঘ্রাণে ভরিয়ে দিয়েছে।
  • লোকবর্ণনামূলক গদ্যছন্দে লেখা হলেও এটি আবেগে কাব্যময়।
  • সংলাপধর্মী গঠন পাঠককে দাদুর পাশে বসিয়ে দেয়—যেন তিনিও কবরগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

কবিতার প্রতীক ও চিত্রকল্প

  • কবর: শুধু মৃত্যু নয়, এটি স্মৃতির চিহ্ন, জীবনের ধারাবাহিকতার প্রতীক।
  • ডালিমগাছ: নতুন জীবনের ইঙ্গিত, পুনর্জন্মের আশা।
  • জোনাকি, ঝিঁঝি, পাতার শোক: প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্কের প্রকাশ।

আবেগের গভীরতা ও মানবিক সুর

জসীমউদ্দীন পাঠকের হৃদয়ে এমন এক করুণ অনুরণন সৃষ্টি করেন, যা কেবল বাংলার মাটিতেই সম্ভব।
দাদুর কণ্ঠে শোনা “আয় খোদা! দয়াময়”—এই প্রার্থনাটিতে মানুষের চিরন্তন ভক্তি ও মানবিকতার প্রতিফলন ঘটে।
এই কবিতা শুধু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের অর্থ বুঝতে শেখায়—যে ভালোবাসা মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে।


সাহিত্যিক মূল্য ও প্রভাব

  • “কবর” বাংলা সাহিত্যের লোকজ রোমান্টিসিজম-এর অনন্য নিদর্শন।
  • এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বহু বছর ধরে অন্তর্ভুক্ত।
  • এই কবিতার মাধ্যমে জসীমউদ্দীন প্রমাণ করেন—সহজ কথার মধ্যেই সবচেয়ে গভীর দর্শন লুকিয়ে থাকে।
  • “কবর”-এর আবৃত্তি (যেমন সেলিনা জাহান বা আরিফ শামসুলের কণ্ঠে) বাংলা সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।

প্রেমের কবিতা | ৫০+ দুই লাইনের রোমান্টিক কবিতা

উপসংহার

কবর” শুধুমাত্র এক বেদনাময় কবিতা নয়, এটি জীবনের প্রতি এক চিরন্তন শ্রদ্ধার গান।
মৃত্যু এখানে কোনো ভয় নয়—এটি ভালোবাসার পরিণতি, স্মৃতির সুরক্ষিত ঠিকানা।
জসীমউদ্দীন তাঁর সহজ কথায় আমাদের শিখিয়েছেন,

“মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে লাগায়ে বুক।”
এই এক পঙক্তিতেই লুকিয়ে আছে সমগ্র মানবজীবনের সারমর্ম।

FAQ: ‘কবর’ কবিতা নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন

‘কবর’ কবিতার মূল বার্তা কী?

মৃত্যু জীবনের অংশ—তবু ভালোবাসা ও স্মৃতি টিকে থাকে; কবর স্মৃতির প্রতীক।

Ayan

আয়ান, বাংলা ভাষার প্রেমে পড়া একজন সৃজনশীল লেখক, যিনি মনোমুগ্ধকর ক্যাপশন, স্ট্যাটাস ও উক্তি লিখে পাঠকদের মন জয় করেন। শব্দের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ করাই তাঁর অন্যতম নেশা। ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা, বন্ধুত্ব, হাসি-মজা—সব ধরনের ক্যাপশন লেখার ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা অসাধারণ। পছন্দের বিষয়: ক্যাপশন রচনা, সাহিত্য, উক্তি ও জীবন দর্শন।

Leave a Comment