15+ কষ্টের গল্প | ইমোশনাল লাভ স্টোরি 2025

By Ayan

Published on:

মানুষের জীবনে কষ্ট এমন এক অনুভূতি, যা কাউকে এড়িয়ে যায় না। কষ্টের গল্প মানে শুধু দুঃখ নয়, বরং জীবনের বাস্তবতা, শিক্ষা আর সংগ্রামের চিত্র। এই গল্পগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়—যে মানুষ কষ্ট সহ্য করতে জানে, সে-ই একদিন সত্যিকারের সাফল্যের স্বাদ পায়। অনেকেই ভালোবাসার কষ্ট, অবহেলার কষ্ট বা ব্যর্থতার কষ্টের মধ্যে দিয়ে জীবনের অর্থ খুঁজে পান। তাই প্রতিটি কষ্টের গল্প আমাদের শেখায়, কষ্টই জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক।

কষ্টের গল্প: হাল না ছাড়া জীবন

একজন মানুষ ছিল, নাম মিজান। ছোটবেলায় তার পরিবারে অভাবের শেষ ছিল না। বাবা অসুস্থ, মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে সে চা দোকানে কাজ করত, যাতে পড়ার খরচ চালানো যায়।

বাচ্চারা তার পুরনো জামা দেখে হাসত, কিন্তু সে হাসত না — কারণ সে জানত, হাসির চেয়েও বড় কিছু আছে, সেটা হলো স্বপ্ন।

একদিন তার বাবা মারা গেলেন। সংসারের ভার পুরোপুরি তার কাঁধে পড়ল। সে পড়াশোনা ছেড়ে কাজ শুরু করল। সকালে চা বিক্রি করত, রাতে দোকানের মেঝেতে ঘুমাত।
তবুও একদিন এক বৃদ্ধ শিক্ষক তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে বিনা পয়সায় পড়াব। কষ্টকে ত্যাগ মনে কোরো না, ওটাই তোমার শক্তি।”

এই কথাটা তার জীবন বদলে দিল।

মিজান আবার পড়া শুরু করল। দিনে কাজ, রাতে পড়া — চোখে ঘুম নেই, শরীরে ক্লান্তি, তবুও মনে আগুন।
পরীক্ষার দিনগুলোতে অনেক সময় কিছু না খেয়ে বসে থাকত, কিন্তু তার কলম থামত না।

বছর ঘুরে সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল। সবাই অবাক — যে ছেলে একসময় রাস্তায় চা বিক্রি করত, সে আজ শহরের সেরা কলেজে ভর্তি হলো!

পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরি, এবং একদিন নিজের ছোট ব্যবসা শুরু করল। আজ মিজান সফল একজন উদ্যোক্তা।
কিন্তু সে প্রতিদিন সকালে মায়ের পুরনো চুলার পাশে বসে দোয়া করে —
“হে আল্লাহ, কষ্ট আমাকে ভাঙেনি, আমাকে তৈরি করেছে।”


এই গল্পের শিক্ষা:
১. কষ্ট মানেই ব্যর্থতা নয়; কষ্ট মানুষকে শক্ত করে।
২. যে নিজের জীবনের দায় নেয়, আল্লাহ তার জন্য দরজা খুলে দেন।
৩. সাফল্যের পেছনে সবসময় লুকিয়ে থাকে অজস্র অশ্রু, ঘাম, আর ধৈর্য।


একটা সত্য মনে রাখো —

“জীবন কখনো সহজ হয় না, কিন্তু যার হৃদয়ে আশা আছে, সে একদিন নিজের গল্প নিজেই লিখে ফেলে।”

ইমোশনাল লাভ স্টোরি

তারা দুজন—রায়হান ও মেহজাবিন—বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী।
প্রথম দেখাতেই রায়হানের মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগে।
মেহজাবিন ছিল শান্ত, লাজুক, কিন্তু তার হাসিতে ছিল এক ধরনের শান্তি, যেন পৃথিবীর সব অস্থিরতা থেমে যায়।

রায়হান কখনো সরাসরি বলতে পারেনি যে সে তাকে ভালোবাসে। শুধু প্রতিদিন ক্লাসে তার জন্য একটা সিট ফাঁকা রাখত, নোটস বানাত, আর দূর থেকে তাকিয়ে থাকত।

চার বছর কেটে গেল, স্নাতক শেষ হলো।
বিদায় অনুষ্ঠানের দিন রায়হান তাকে একটি খাম দিল।
বলল, “এটা পরে খুলবে।”
তারপর তারা আলাদা হয়ে গেল — কেউ চাকরির খোঁজে, কেউ পরিবারের দায়ে।

মেহজাবিন খামটা খুলে দেখল—ভিতরে একটি চিঠি।
রায়হান লিখেছিল,
“তুমি যদি কখনো কষ্ট পাও, জানবে, কোথাও একজন মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে তোমার জন্য দোয়া করছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু তোমাকে হারাতে চাই না আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তাই তোমার সুখই আমার দোয়া।”

তারপর বহু বছর কেটে গেল।
মেহজাবিনের বিয়ে হয়ে গেল বিদেশে।
রায়হানও নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, কিন্তু কাউকে বিয়ে করল না।

একদিন এক চিঠি এল রায়হানের ঠিকানায়—প্রেরক: মেহজাবিন।
চিঠিতে লেখা ছিল—
“তুমি বলেছিলে, আমার সুখের জন্য দোয়া করো। আমি সুখী নই, কিন্তু তোমার সেই দোয়াই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যদি আবার দেখা হয়, আমি শুধু ধন্যবাদটা বলতে চাই।”

চিঠি পড়ে রায়হান অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হে আল্লাহ, আমি তার সুখ চেয়েছিলাম। যদি আমার প্রার্থনা অসম্পূর্ণ থাকে, আজও আমি সেই দোয়া করছি।”

বছর পর রায়হান একা বসে জানালার পাশে মেহজাবিনের পুরোনো চিঠি পড়ে।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।
একফোঁটা বৃষ্টির জল তার গাল বেয়ে নামল — হয়তো অশ্রু, হয়তো স্মৃতি।


গল্পের শিক্ষা:

১. ভালোবাসা মানে শুধু কাছে পাওয়া নয়; কখনো দূরে থেকেও কাউকে ভালোবাসা যায়।
২. সত্যিকারের প্রেম কখনো শেষ হয় না — শুধু রূপ বদলে যায়।
৩. ত্যাগই ভালোবাসার সবচেয়ে পবিত্র প্রকাশ।

গল্পের নাম: “তোমার জন্য অপেক্ষা”

একদম ঠিক আছে ❤️
তুমি চাও একটি ভালোবাসার কষ্টের গল্প (প্রায় ১০০০ শব্দে) — বাস্তবঘেঁষা, আবেগপূর্ণ, যেন মনে হয় কোনো সত্য ঘটনা।
এখানে আমি তোমাকে এমনই একটি গল্প দিচ্ছি, যেখানে ভালোবাসা আছে, অপেক্ষা আছে, আর আছে এমন এক কষ্ট যা শব্দে বলা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।

গল্পের নাম: “তোমার জন্য অপেক্ষা”

রাত তখন প্রায় বারোটা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার কাঁচে টুপটাপ শব্দ পড়ছে। আমি একা বসে আছি, সামনে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া এক কাপ চা। ঘড়ির কাঁটা যেন আটকে আছে সেই সময়ে—যেদিন তুমি শেষবার বলেছিলে, “আমি ফিরে আসব।”

আমার নাম আদিল। আমি একজন সাধারণ মানুষ—একটা ছোট চাকরি করি, একঘেয়ে জীবন। কিন্তু এই একঘেয়েমির মাঝেই একদিন তুমি এসেছিলে, নীলা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে রঙিন অধ্যায়। প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকেই তোমাকে দেখেছিলাম। তুমি বসেছিলে জানালার পাশে, বাতাসে তোমার চুল উড়ছিল। আমি তখনো জানতাম না, সেই বাতাস একদিন আমার জীবন এলোমেলো করে দেবে।

প্রথমে আমরা বন্ধু হলাম। লাইব্রেরিতে একসঙ্গে পড়া, ক্যান্টিনে চা ভাগ করে খাওয়া, নোটস আদান-প্রদান—সবকিছু যেন ধীরে ধীরে এক অজানা অনুভূতির পথে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, তোমার হাসি আমার দিনের শুরু আর রাতের শেষ হয়ে যাচ্ছে।

তুমি খুব স্বপ্নবাজ মেয়ে ছিলে। সবসময় বলত, “আমি বড় হব, কিছু করে দেখাব, কিন্তু কাউকে নির্ভর করে নয়—নিজের মতো করে।”
তোমার সেই আত্মবিশ্বাসই আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

একদিন বিকেলে বৃষ্টির পর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের পুরনো গাছটার নিচে বসে ছিলাম। তোমার চোখে পড়েছিল রোদ, আমি তাকিয়ে ছিলাম চুপচাপ। তুমি হঠাৎ বললে,
“আদিল, তুমি কখনো কাউকে হারানোর ভয় পাও?”
আমি হেসে বলেছিলাম, “তোমাকে হারানোর কথা ভাবতেও পারি না।”
তুমি একটু হাসলে, তারপর দূরে তাকিয়ে বললে, “কিছু মানুষ থাকে না সারাজীবন, কিন্তু তারা চিরকাল মনে থেকে যায়।”

সেদিন বুঝিনি, তুমি হয়তো নিজের ভবিষ্যতের কথাই বলেছিলে।

কয়েক মাস পর জানতে পারলাম তোমার বাবার চাকরি বদলি হয়েছে—তোমাদের পুরো পরিবার ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে যাচ্ছে।
আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
শেষ দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে তোমার সঙ্গে দেখা হলো। বৃষ্টি হচ্ছিল, তুমি ভেজা চুলে দাঁড়িয়ে বললে,
“তুমি কাঁদছো না?”
আমি হেসে বললাম, “তুমি তো ফিরে আসবে।”
তুমি বললে, “হয়তো… কিন্তু যদি না আসি, তাও মনে রেখো—আমরা একে অপরের জীবন বদলে দিয়েছি।”
তারপর তুমি চলে গেলে।

প্রথম দিকে ফোনে কথা হতো, মেসেজ, ইমেইল—সবই চলছিল।
কিন্তু ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমতে লাগল।
তুমি বলেছিলে, “নতুন জায়গা, নতুন কাজ, সময় পাচ্ছি না।”
আমি বিশ্বাস করেছিলাম।
একদিন ফোন করতেই শুনলাম অপর প্রান্তে একজন অচেনা পুরুষের কণ্ঠ। তুমি বললে, “আদিল, আমার বাগদান হয়ে গেছে।”

আমার পৃথিবী থেমে গেল।
আমি কিছু বলিনি, শুধু ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম।
বাইরে তখন ঝড় হচ্ছিল। আকাশের মেঘগুলো যেন আমার বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্টের মতো।

সেদিন রাতটা মনে আছে—আমি ঘুমাতে পারিনি। বারান্দায় বসে ছিলাম, বাতাসে তোমার দেওয়া স্কার্ফটা উড়ছিল। মনে হচ্ছিল, তুমি আছো, ঠিক পাশে বসে আছো, শুধু চোখে দেখা যাচ্ছে না।

দিন, মাস, বছর কেটে গেল।
আমি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু যতই চেষ্টা করি, তোমার নামটা ভুলতে পারিনি।
প্রতিটি সকালে অফিস যাওয়ার আগে তোমার পাঠানো পুরনো মেসেজটা পড়ে নিতাম—
“তুমি পারবে আদিল, একদিন তোমার নাম সবাই জানবে।”
তোমার সেই বিশ্বাসটাই ছিল আমার বেঁচে থাকার শক্তি।

কয়েক বছর পর একদিন হঠাৎ রাস্তায় তোমাকে দেখলাম।
তুমি পরিপূর্ণ নারী—চোখে ক্লান্তি, কপালে সিঁদুর, পাশে একটা ছোট বাচ্চা।
তুমি আমাকে চিনলে, মৃদু হাসলে, বললে,
“তুমি ভালো আছো?”
আমি মাথা নাড়লাম, “হ্যাঁ, ভালো আছি।”
তুমি বললে, “জানো, তোমার কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। তুমি সেই মানুষ, যে আমাকে নিজেকে চিনতে শিখিয়েছিলে।”
আমি হাসলাম, বললাম, “আর তুমি সেই মানুষ, যাকে হারিয়ে আমি নিজেকে চিনেছি।”

আমাদের মাঝের নীরবতায় ছিল হাজারো কথা, যা কেউ উচ্চারণ করল না।
তুমি বললে, “আমি চলি, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আমি শুধু বললাম, “যেও, কিন্তু একবার তাকিও আকাশের দিকে—আমার প্রার্থনা ওখানেই থাকে।”

তুমি চলে গেলে।
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ, যতক্ষণ না তোমার গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

সেই রাতে আবার বৃষ্টি পড়েছিল।
আমি জানালার পাশে বসে পুরনো মেসেজগুলো খুলে দেখছিলাম।
একটায় তুমি লিখেছিলে—
“যদি কোনোদিন আমি চলে যাই, মনে রেখো—ভালোবাসা কখনো হারায় না, শুধু মানুষ বদলে যায়।”

আজও মাঝে মাঝে তোমার কথা মনে পড়ে।
যখন ভোরের আলোয় শহর ধীরে ধীরে জেগে ওঠে, তখন মনে হয়, তুমি কোথাও আছো—
হয়তো কোনো জানালার পাশে, তোমার সন্তানের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছো,
আর আমি এখানেই, এখনো সেই একই আকাশের নিচে তোমার জন্য প্রার্থনা করছি।

ভালোবাসা পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব নয়।
ভালোবাসা মানে হৃদয়ে এমন একটা জায়গা তৈরি করা,
যেখানে অন্য কেউ এলে ওর নাম মুছে না, শুধু একটু পাশে সরে যায়।


শেষ কথা:

না-পাওয়া ভালোবাসা আসলে শেষ নয়।
এটাই জীবনের সবচেয়ে গভীর অনুভূতি—যা মানুষকে কাঁদায়, আবার বড়ও করে তোলে।
যে ভালোবাসা অসম্পূর্ণ থাকে, সেটাই মনে সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করে।
কখনো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু হৃদয়ের ভেতরে থাকে সারাজীবন…
যেভাবে আমি এখনও প্রতিরাতে জানালার পাশে বসে থাকি,
তোমার দেওয়া সেই প্রথম হাসিটা মনে রেখে।

বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

রুমানা ছিল এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। বাবা দিনমজুর, মা অন্যের বাসায় কাজ করতেন।
স্কুলে যেতে হতো হেঁটে — কখনো খালি পায়ে, কখনো ছেঁড়া স্যান্ডেল পরে।
বৃষ্টির দিনে রাস্তা কাদা হয়ে যেত, কিন্তু সে থামত না। কারণ সে জানত, “শিক্ষাই আমার একমাত্র পথ।”

একদিন ক্লাসে এক ছাত্রী তার ছেঁড়া স্যান্ডেল দেখে হাসল। রুমানার চোখে জল চলে এলো, কিন্তু কিছু বলল না।
বাড়ি ফিরে মা’কে বলল, “মা, আমার পড়তে ইচ্ছে করছে না।”
মা তার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“বাবা, মানুষ তোমাকে হাসবে যতক্ষণ না তুমি সফল হও। যখন তুমি উঁচুতে উঠবে, তখন তারা তোর সাফল্যে তাকাবে।”

এই কথাটাই রুমানার জীবন বদলে দিল।

সে আগের চেয়ে দ্বিগুণ পরিশ্রম শুরু করল।
দিনে ক্লাস, রাতে মোমবাতির আলোয় পড়াশোনা।
অনেকদিন খালি পেটে থেকেছে, কিন্তু বই বন্ধ করেনি।

একদিন পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলো—
রুমানা পুরো উপজেলায় প্রথম হলো।
পুরো স্কুল তাকিয়ে দেখল সেই মেয়েটির দিকে, যাকে একসময় সবাই উপহাস করত।

পরে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো, আবারও বৃত্তি পেল।
আজ সে একজন সরকারি কর্মকর্তা, নিজের পরিবারসহ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাচ্ছে।
কিন্তু তার ঘরের এক কোণে এখনও সেই পুরোনো ছেঁড়া স্যান্ডেলটা আছে —
সে বলত,
“এই স্যান্ডেল আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমি কোথা থেকে এসেছি।”


এই গল্পের শিক্ষা:

১. কষ্ট তোমাকে ভাঙতে পারে না, যদি তুমি নিজেকে বিশ্বাস করো।
২. হাসাহাসি, উপহাস—এসব একদিন তোমার শক্তির জায়গা হয়ে যায়।
৩. যারা কষ্ট থেকে উঠে আসে, তাদের সাফল্য সবচেয়ে মূল্যবান।


একটা সত্যি কথা মনে রাখো —

“জীবনে কষ্ট না থাকলে মানুষ কখনো বড় হতে শেখে না।”

১২+ সফলতার শিক্ষনীয় গল্প ২০২৫

অবহেলার কষ্টের গল্প

রোকেয়া বেগম ছিলেন এক সাধারণ মা।
স্বামী মারা যাওয়ার পর নিজের দুই ছেলেকে মানুষ করার জন্য জীবন বাজি রেখে পরিশ্রম করেছেন।
দিনে অন্যের বাসায় কাজ করতেন, রাতে সেলাই করতেন।
নিজের শরীরের যত্ন নেননি, কিন্তু ছেলেদের মুখে অভাবের কথা আসতে দেননি।

বছর কেটে গেল, দুই ছেলে বড় হলো।
একজন বিদেশে চাকরি পেল, আরেকজন শহরে ব্যবসা শুরু করল।
রোকেয়া ভাবলেন, “এখন একটু শান্তিতে বাঁচব, সন্তানরা তো এখন স্বাবলম্বী।”

কিন্তু বাস্তবতা ছিল নির্মম।
যে ছেলেরা একসময় তার কোলে মাথা রেখে ঘুমাত, তারা এখন ফোনেও কথা বলতে ব্যস্ত।
মাসে মাসে টাকা পাঠায় ঠিকই, কিন্তু খোঁজ নেয় না।

একদিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রতিবেশী মহিলা এসে বলল, “তোমার ছেলেদের খবর দিই?”
রোকেয়া হেসে বললেন, “না বোন, ওরা খুব ব্যস্ত, আমি ওদের বিরক্ত করতে চাই না।”

সেই রাতে তিনি একা ঘরে বসে ছিলেন।
পুরোনো অ্যালবাম খুলে দেখলেন ছেলেদের ছোটবেলার ছবি।
একটা ছবিতে দুই ছেলেকে কোলে নিয়ে হাসছেন—মুখে অজস্র ভালোবাসা।
ছবিতে নিজের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
“দেখো রোকেয়া, তখন তুমি ছিলে তাদের পৃথিবী, আর আজ তুমি শুধু একটা অতীত।”

কয়েক মাস পর তিনি মারা গেলেন।
ছেলেরা খবর পেয়েছিল, কিন্তু একজনের ভিসার ঝামেলা, আরেকজনের ব্যবসার ব্যস্ততা—তারা কেউ আসেনি।
পাশের মানুষরা কবর দিলেন তাকে, গ্রামের শেষ প্রান্তে, যেখানে সূর্যাস্তে আলো পড়ে, কিন্তু কেউ দাঁড়িয়ে থাকে না।


এই গল্পের শিক্ষা:

১. পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টের সম্পর্ক হলো অবহেলিত ভালোবাসা
২. মা-বাবার ভালোবাসা কখনো বদলে যায় না, কিন্তু সন্তানের উদাসীনতা সেই ভালোবাসাকে নিঃশব্দে হত্যা করে।
৩. সাফল্য তখনই অর্থহীন হয়ে যায়, যখন তার ভাগীদার থাকে না নিজের মানুষগুলো।


একটা কথা মনে রেখো —

“অবহেলায় যে কাঁদে, তার কান্না নিঃশব্দে হলেও পৌঁছে যায় আল্লাহর কাছে।”

না পাওয়া ভালোবাসার কষ্টের গল্প

আরিফ আর নীলা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত।
প্রথম পরিচয় হয়েছিল লাইব্রেরিতে।
নীলা সবসময় শান্ত, পরিপাটি মেয়ে — চোখে একটা গভীর দৃষ্টি, যা কথা না বলেও অনেক কিছু বলে দেয়।
আরিফ ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, সে নীলার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসে।

প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর নিঃশব্দ ভালোবাসা।
তারা একসঙ্গে পড়ত, একসঙ্গে হাঁটত, বৃষ্টির দিনে চুপচাপ ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে থাকত।
কখনো কেউ কাউকে “ভালোবাসি” বলেনি, তবুও দু’জনেই জানত — তাদের হৃদয়ের ভাষা একই।

কিন্তু একদিন নীলা চুপচাপ হয়ে গেল।
ক্লাস শেষে আরিফ জানতে চাইল, “কী হয়েছে?”
নীলা মাথা নিচু করে বলল, “আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে… বাবা-মা রাজি হয়ে গেছেন।”

আরিফের পৃথিবী থেমে গেল।
সে কিছু বলতে পারল না, শুধু মাথা নিচু করে বলল, “তুমি সুখে থেকো… আমি দোয়া করব।”

সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল।
নীলা চলে গেল, আরিফ দাঁড়িয়ে রইল সেই ছাতার নিচে — একা।
তার মনে হচ্ছিল, এই বৃষ্টি যেন তার অশ্রু ঢেকে রাখছে।

বছর কেটে গেল।
আরিফ চাকরি পেল, জীবনে এগিয়ে গেল, কিন্তু হৃদয়ে নীলার স্মৃতি রয়ে গেল এক ক্ষত হয়ে।
রাতে নামাজের পর সে বলত, “হে আল্লাহ, আমি তাকে হারিয়েছি, কিন্তু তুমি যেন তাকে সুখ দাও।
কারণ ভালোবাসা মানে শুধু পাওয়া নয়, কারো মঙ্গল চাওয়া।”

একদিন রাস্তায় হঠাৎ দেখা হলো।
নীলা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাঁটছিল।
আরিফ দূর থেকে হাসল, নীলা তাকিয়ে মৃদু হাসি ফিরিয়ে দিল।
দুজনেই চোখে জল নিয়ে চলে গেল — কোনো কথা হলো না, তবুও মনে হলো, হাজার কথা বলা হয়ে গেছে।


এই গল্পের শিক্ষা:

১. না পাওয়া ভালোবাসা কখনো বৃথা যায় না — এটা মানুষকে পরিণত করে।
২. সত্যিকারের ভালোবাসা হলো দখল নয়, প্রার্থনা।
৩. সময় অনেক কিছু বদলায়, কিন্তু কিছু অনুভূতি চিরকাল বেঁচে থাকে, নিঃশব্দে।


একটা কথা মনে রেখো —

“যে ভালোবাসা অসম্পূর্ণ থাকে, সেটাই সবচেয়ে নির্মল থাকে… কারণ সেখানে প্রত্যাশা নেই, আছে শুধু হৃদয়ের সত্যতা।”

মা বাবাকে নিয়ে কষ্টের গল্প

রহিমা বেগম ও নূরুল ইসলাম দম্পতি একসময় ছিলেন সুখী পরিবার।
তাদের দুই ছেলে, এক মেয়ে — হাসিখুশি সংসার।
বাবা সারা জীবন চাকরি করেছেন, মা সন্তানদের বড় করেছেন নিজের কষ্ট ভুলে।
ছেলেরা বড় হলো, চাকরি পেল, মেয়ে বিয়ে হয়ে গেল।
বাবা অবসর নিলেন, মা বুড়িয়ে গেলেন, কিন্তু ঘরে তাদের কোলাহল নেই —
কারণ সন্তানরা এখন শহরে, ব্যস্ত জীবনে ডুবে গেছে।

একদিন ছোট ছেলে ফোনে বলল,
“বাবা, তোমাদের জন্য আমরা একটা ভালো জায়গা ঠিক করেছি — বৃদ্ধাশ্রম। সেখানে যত্ন নেবে সবাই।”
মা চুপ করে রইলেন। চোখে জল আসলেও বললেন,
“তুমি যদি সুখে থাকো, সেটাই আমাদের শান্তি।”

বৃদ্ধাশ্রমে আসার পর মা-বাবা জানালার পাশে বসে থাকতেন প্রতিদিন।
মা বলতেন, “দেখো নূরুল, হয়তো আজ কেউ আসবে আমাদের দেখতে।”
বাবা নরম গলায় বলতেন, “হয়তো…”

কিন্তু কেউ এল না।
শুধু মাস শেষে এক কর্মচারী এসে টাকা দিয়ে যেত, যেটা ছেলে পাঠাত।

একদিন মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
ডাক্তার বললেন, অবস্থা গুরুতর।
মা বারবার বলছিলেন, “আমার ছেলেকে একবার দেখতে চাই।”
কিন্তু ফোন করলে বলা হলো, “আজ অফিসে মিটিং, কাল আসব।”
পরদিন সকালে তিনি আর ছিলেন না।

বাবা কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলেছিলেন,
“সে আসবে, কিন্তু এখন নয় — যখন দেরি হয়ে যাবে।”

সেই দিন সন্ধ্যায় ছেলে এলো — হাতে ফুল, চোখে জল।
কিন্তু মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু কাঁদতে পারল।
বাবা ধীরে ধীরে বললেন,
“তুমি এসেছো ঠিকই, কিন্তু মা অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে।”


এই গল্পের শিক্ষা:

১. মা-বাবা চায় না অর্থ, চায় শুধু একটু সময়।
২. যে মানুষকে একদিন তুমি ‘বাবা-মা’ বলে ডাকতে, তাদের অপেক্ষা যেন বৃথা না যায়।
৩. ভালোবাসা প্রকাশের সময় চলে গেলে, অনুতাপ কোনো অর্থ রাখে না।


একটা সত্যি কথা মনে রেখো —

“মা-বাবা চলে গেলে তুমি যা-ই অর্জন করো, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আশীর্বাদটা হারিয়ে ফেলবে চিরতরে।”

ছাত্র জীবনের কষ্টের গল্প

শহরের রাস্তায় প্রতিদিন রাতে এক ছেলেকে দেখা যেত—
হাতে বই, পাশে একটা পুরনো ব্যাগ, আর মাথার ওপর কেবল একটা ল্যাম্পপোস্টের আলো।
তার নাম নাঈম।
সে ছিল এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান; বাবা রিকশাচালক, মা গৃহকর্মী।
বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই, তাই রাতে রাস্তার আলোতেই পড়াশোনা করত।

প্রতিদিন রাতের শেষে পুলিশ তাকে তাড়াতো, পথচারীরা কৌতূহল নিয়ে তাকাত।
কেউ বলত, “এই ছেলে পাগল, ঘরে না গিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে!”
কিন্তু সে জানত, একদিন এই বইয়ের পাতাই তার ভবিষ্যৎ বদলে দেবে।

অনেক সময় ক্ষুধা নিয়ে বই পড়ত।
মা চুপচাপ শুকনো রুটি হাতে দিত, বলত,
“বাবা, তুই একদিন মানুষ হ, আমার মুখে যেন মানুষ পানি দেয়।”

পরীক্ষার দিন এল।
সে খালি পেটে পরীক্ষায় গেল, কিন্তু কলম থামাল না।
বন্ধুরা যেখানে কোচিংয়ে হাজার টাকা দিচ্ছিল, নাঈম সেখানে ইউটিউব আর পুরনো নোটে পড়ে শিখেছিল সবকিছু।

ফল প্রকাশের দিন, নাঈম জেলায় প্রথম হলো।
পত্রিকায় খবর বের হলো — “ল্যাম্পপোস্টের নিচের ছেলেটা আজ সবার অনুপ্রেরণা।”

সেদিন সে কাঁদছিল—আনন্দে নয়, কৃতজ্ঞতায়।
কারণ সে জানত, সেই রাস্তাটা, সেই আলো, আর তার মায়ের শুকনো রুটিই তাকে এতদূর নিয়ে এসেছে।

আজ নাঈম একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
রাতে যখন রাস্তায় কোনো দরিদ্র ছেলেকে ল্যাম্পপোস্টের নিচে বই হাতে দেখতে পায়,
সে থেমে যায়, গিয়ে একটা পানির বোতল আর চকোলেট দেয়, আর মনে মনে বলে,
“আমি তোমার অতীত জানি, কারণ আমি নিজেই ছিলাম তুমি।”


এই গল্পের শিক্ষা:

১. ছাত্রজীবনের কষ্টই ভবিষ্যতের শক্তি।
২. দারিদ্র্য বাধা নয় — মনোবল থাকলে একদিন সবার চেয়ে উঁচুতে ওঠা যায়।
৩. যারা আজ পরিশ্রম করছে, কাল তাদের নামেই ইতিহাস লেখা হবে।


একটা কথা মনে রেখো —

“যে ছাত্র অন্ধকারে থেকেও আলো খুঁজে নেয়, সে-ই একদিন অন্যদের জন্য আলো হয়ে ওঠে।”

অপেক্ষা নিয়ে কষ্টের গল্প

রিলেশনের কষ্টের গল্প

সায়েম আর মিতু—দুজন ছিল একে অপরের জীবনের অভ্যেসের মতো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে পরিচয়,
কফির টেবিলের পাশে, লাইব্রেরির করিডরে,
তাদের হাসি, ঝগড়া, আর একে অপরের যত্নে গড়ে উঠেছিল একটা গভীর সম্পর্ক।

মিতু সবসময় বলত, “তুমি যদি আমার পাশে থাকো, আমি যেকোনো কিছু সহ্য করতে পারব।”
আর সায়েম বলত, “আমি তোমার হাসি ছাড়া পৃথিবী কল্পনাও করতে পারি না।”

কিন্তু জীবন কখনো কখনো ভালোবাসাকে পরীক্ষা নেয়,
যেমনটা নিল তাদের।

মিতুর বাবার ট্রান্সফার হলো বিদেশে,
পরিবার চাইল না সে আর সায়েমের সঙ্গে সম্পর্ক রাখুক।
চাপ, কান্না, অভিমান—সব মিশে গেল এক অদ্ভুত নীরবতায়।

একদিন মিতু ফোনে বলল,
“সায়েম, আমি পারছি না আর। পরিবার চাইছে না… আমি যাচ্ছি।”
সায়েম শুধু বলল, “তুমি সুখে থেকো, আমি প্রার্থনা করব।”
মিতু কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে দিল।

তারপর ফোন, মেসেজ—সব বন্ধ।
সায়েম প্রতিদিন রাত ১২টার দিকে মোবাইল হাতে নিত,
দেখত স্ক্রিনে কোনো নাম জ্বলে উঠছে কি না।
কিন্তু কিছুই না।

বছর কেটে গেল।
একদিন সায়েমের ফোনে অচেনা নম্বর থেকে কল এল।
ওপাশ থেকে খুব দুর্বল কণ্ঠ,
“সায়েম… আমি মিতু…”

সায়েম হতভম্ব, বলল, “তুমি! কোথায় ছিলে এতদিন?”
ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ,
“আমি অসুস্থ… শেষ পর্যায়ে।
তোমাকে শুধু বলতে চেয়েছিলাম—তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মানুষ।”

ফোন কেটে গেল।
তারপর আর কোনো কল এল না।

এক সপ্তাহ পর এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর এল—
মিতু মারা গেছে।
সায়েম তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি সুখে থেকো, মিতু। আমি তোমার বলা কথাটাই এখন জীবনের একমাত্র সত্য মনে করি।”

আজও সায়েম প্রতিদিন রাত ১২টার দিকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“শেষ কলটা আমি ভুলব না… কারণ ওটা ছিল আমার জীবনের শেষ ভালোবাসা।”


এই গল্পের শিক্ষা:

১. ভালোবাসা সবসময় একসঙ্গে থাকার নাম নয় — কখনো সেটা বিদায়ের মধ্যেও থাকে।
২. সত্যিকারের সম্পর্ক ভাঙে না, শুধু নীরব হয়ে যায়।
৩. ভালোবাসা যত গভীর হয়, বিচ্ছেদ তত কষ্টদায়ক — কিন্তু সেই কষ্টই প্রমাণ করে ভালোবাসাটা সত্য ছিল।


একটা কথা মনে রেখো —

“যে ভালোবাসা তুমি হারিয়েছ, সেটাই হয়তো তোমার জীবনের সবচেয়ে খাঁটি ভালোবাসা ছিল।”

কষ্টের গল্প: অপূর্ণ থেকে যাওয়া জানালার আলো

রাত তখন বারোটা ছুঁইছুঁই। ড্রয়িংরুমের জানালার পর্দা অর্ধেক নামানো, বাইরে মৃদু বৃষ্টি। আমি টেবিলল্যাম্পটা একটু নিচু করি—আলোর বৃত্ত ছোট হয়ে আসে, কাগজের ওপর আমার হাতটা কাঁপতে থাকে। এই শহরে এসে তিন বছর হয়ে গেল, তারপরও মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যেন এখনও সেই পুরোনো হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, লনে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে, একটা মেয়ের চুল উড়ছে, আর আমার বুকের ভেতর কোনো শব্দ নেই। শুধু একটা অনুভূতি—যেটাকে কখনো বলিনি, বলার সাহস হয়নি।

আমার নাম আরিফ। আমি ঢাকায় একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কাজ করি। সকাল ন’টা থেকে রাত আটটা, তারপর মেট্রোরেলে ফিরি—স্টেশনের ভিড়, সিঁড়ির ধাপ, দোকানের আলোর রেখা—সবকিছু পার হতে হতে মনে পড়ে সেই কয়েকটা বছর, যেগুলোকে আমি মনে মনে ডাকতাম ‘উল্টো দিকের নদী’। যেখানে নদী বয়ে যায়, কিন্তু তুমি টের পাও না কখন ভিজে গেলে।

আমাদের পরিচয় হয়েছিল বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের সামনে ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়ি, ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম। মামার বাড়ির এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় সর্দি-জ্বরে ভর্তি, মাকে নিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালের সেই পুরোনো বারান্দা, লৌহ-গেটের গোলাকার নক, বাতাসে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ—সবকিছু মিলিয়ে মাথা ঝিমিয়ে যাচ্ছিল। বাইরে বেরিয়ে চা খেতে গিয়েছি, বৃষ্টির পানি টপটপ করে টিনের চাল থেকে পড়ছে। তখনই প্রথম দেখলাম তাকে—নীল সালোয়ার, ভেজা ওড়না, ভেজা চোখ নয়, কিন্তু লাল হয়ে আছে জেগে থাকার ক্লান্তিতে। চা-ওয়ালা এক কাপ চা এগিয়ে দিতেই সে বলল, “চিনি লাগবে না, আঙ্কেল।” আঙ্কেল শব্দটা শুনে চা-ওয়ালার হাসি পেল, আমারও। এত স্পষ্ট, এত নির্ভুল কণ্ঠ—যেন কোথাও ভুল নেই, কোথাও দ্বিধা নেই।

আমি চা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সে বাঁ দিকে সরল, আমার কনুই তার কনুই ছুঁলো। ছোট একটা ক্ষমা চাওয়ার হাসি দিয়ে সে বলল, “সরি।” এই একটা শব্দ… আমি আজও ভুলতে পারিনি। চায়ের কাপ কাঁপল, ধোঁয়া আমার চশমায় ধাঁধা কেটে দিল।

তার নাম ছিল নবনী। বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে—বাবা দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিক, সেই রাতে সুগার খুব বেশি নেমে গিয়েছিল। সে বলল, “আমি এখানে প্রায়ই আসি। ইন্টার্ন ডাক্তারদের কেউ না কেউ চেনে।” আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম, কত সহজে সে কাঁধের ভাঁজগুলো সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের কথাবার্তা খুব বেশি হলো না। আমি বললাম, “আমি আরিফ।” সে বলল, “আমি নবনী।” তারপর বৃষ্টিটা যেন একটু জোরে পড়তে শুরু করল।

দু’দিন পর ওকে আবার দেখলাম। হাসপাতালের লন ঘেঁষে একটা ছোট্ট লাইব্রেরি ছিল—রোগীর স্বজনরা বসে থাকে, কেউ কেউ পুরোনো পত্রিকা পড়ে। আমি দুপুরে সেখানে ঢুকে একটা মেডিকেল ম্যাগাজিন উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। নবনী এসে পাশের বেঞ্চে বসল। হাতদুটো টেবিলের ওপর রাখল। আমি তাকাতেই সে বলল, “আপনি কি এখানকার?” “না,” আমি বললাম, “ঢাকার। বরিশালে মামার বাড়ি।” “তাহলে আপনি কেন বার বার এখানে?” তার প্রশ্নটা সোজাসুজি। আমি হেসে বললাম, “আপনিই তো বার বার আমাকে দেখে ফেলছেন।”

আমরা ধীরে ধীরে কথা বাড়ালাম। শুনলাম নবনী ইংরেজি সাহিত্যে পড়ে, বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। কবিতা পড়তে ভালোবাসে—কাজী নজরুলের “বিদ্রোহী” পড়লে ওর বুকের ভেতর আগুন জ্বলে ওঠে, জীবনানন্দ পড়লে নদীর গন্ধ পায়। আর রবীন্দ্রনাথ—তার কাছে রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টির মতো, যে আলাদা করে নামতে হয় না, নিঃশব্দে ভিজিয়ে দেয়। আমি হাসলাম। বললাম, “তুমি কি কখনো ঢাকা যেতে চাও?” সে চোখ সরু করে বলল, “যেতে চাই, কিন্তু ঢাকা আমার নয়—আমার শহর বরিশাল। এখানেই আমি নদীর ধারে হাঁটতে পারি।”

আমাদের দেখা হওয়া শুরু হল নিয়মিত। কখনো হাসপাতালের লাইব্রেরি, কখনো সেই চায়ের দোকান, কখনো কাঁচাবাজারের এক কোণে, যেখানে বিকেলে সে বাসায় ফেরার আগে মাছ কিনে নিয়ে যায়। আমি তৎক্ষণাৎ বুঝে গেলাম, আমার বুকের ভেতর যে খালি জায়গাটা ছিল, সেটার নাম হয়তো নবনী। কিন্তু আমি কিছু বলিনি—কারণ জানতাম, জীবন সব সময় গল্পের মত সাজানো থাকে না। আর আমি তখনও নিজের জীবনটা নিয়ে নিরাপদ নই। পড়াশোনা শেষ, চাকরির অনিশ্চয়তা, পরিবারের প্রত্যাশা—আমি ভাবলাম, আমি এখন অনুভূতিগুলোকে শুধু হাতে ধরে রাখি, মুখে আনি না।

ওদিকে নবনীর বাবার অসুস্থতা বাড়তে লাগল। এক রাতে ফোন পেলাম—ওর বাবাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে। আমি সাইকেলে করে হাসপাতালে গেলাম। আইসিইউর বাইরে বেঞ্চে বসে নবনী হাত জড়িয়ে রেখেছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। আমি পানির বোতল এগিয়ে দিলাম। ও বোতলটা ধরল, একটু পান করল, তারপর বলল, “আমার বাবা খুব গুছিয়ে মানুষ ছিলেন। টেবিলের ওপর কাগজগুলো না গুছিয়ে তিনি কখনো ঘুমাতেন না। আমি হঠাৎ বুঝতে পারছি, মানুষের জীবনে গুছোনোর চেয়ে জরুরি কিছু নেই—যার নাম বলা হয় ভালোবাসা।”

আমি বললাম, “তুমি বিশ্রাম নাও। আমি এখানেই বসে আছি।” সে মাথা নাড়ল। রাত তিনটা পর্যন্ত আমরা কোনো কথা বলিনি। মেডিসিন ওয়ার্ডের করিডোরে লাল আলো জ্বলছিল, সিস্টারের পায়ের শব্দ, পাম্পের মৃদু ভোঁ ভোঁ—সব মিলিয়ে একটা থমথমে রাত। আমি আড়চোখে দেখলাম, নবনীর চোখে অশ্রু জমে আছে। আমি কিছু বলিনি। আমাদের নীরবতা ছিল সেই রাতের একমাত্র নিরাপদ শব্দ।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নবনীর বাবা একটু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। সেইদিন সন্ধ্যায় নদীর ধারে হাঁটতে গিয়ে নবনী বলল, “তুমি জানো, আমি তোমার সঙ্গে কথা বললে একটা অদ্ভুত শান্তি পাই। যেন শব্দটা আমার নয়, তবু আমারই।” আমি চুপ করলাম। নদীর ঢেউ পাতার চূড়ায় এসে লাগছিল, ছোট ছোট নৌকা স্থির হয়ে ভাসছিল। আমি বললাম, “আমারও তাই লাগে।” কথাটা আমার মুখ দিয়ে বের হলো, কিন্তু যার গভীরতা ছিল মাটির অনেক নিচে। নবনী হাসল।

তারপর আমাদের সামনে ঢুকে পড়ল বাস্তব। বছরের শেষ, আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। নতুন সেমিস্টার, নতুন চিন্তা। নবনী বরিশালে—বাবার চিকিৎসা, পড়াশোনা, ঘরের কাজ। আমরা ফোনে কথা বলতাম, রাতে বারান্দার কোণ থেকে। আমার কাজের চাপ বাড়ল, ওরও পড়ার চাপ। আমরা দেখা করতাম তিন মাস, চার মাস, কখনো ছয় মাস পর। যখনই বরিশাল যেতাম, স্টিমারে চড়ে নামতে না নামতেই একটা মেসেজ—”স্টেশন রোডে আছি।” আর আমি ছুটে যেতাম। এই সব ছোট ছোট মুহূর্ত—এগুলোই ছিল আমাদের সব।

এমন এক সময়ে সবকিছু বদলে গেল—খুব সাধারণভাবে, হঠাৎ, একদিন ভিজে দুপুরে। আমার বাবা একদমই চান না আমি “অনিশ্চিত” কোনো সম্পর্কের মধ্যে ঢুকি। তিনি অবসরের পর ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা, বাড়ির খরচ—সব মিলিয়ে আমার ওপর একটা নিঃশব্দ চাপ। সে চাপের ভেতরেই একদিন মা বলল, “ঢাকার পাশেই একটা ভালো পরিবার দেখেছি, মেয়ে এমবিএ পড়েছে। তোর সঙ্গে ভাবতে পারি।” আমি চোখ নামিয়ে বললাম, “আমি এখনই—” মা বললেন, “এখনই কিছু না। পরিচয় করে দিই, তারপর দেখ।” আমি জানতাম, এই “দেখা” মানে দেখতে দেখতে সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। আর আমার নিজের ভেতর একটা সত্য লুকিয়ে আছে, যেটা আমি কাউকে বলিনি—নবনী ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারি না।

সেই রাতে আমি নবনীকে ফোন করলাম। নদীর বাতাসের শব্দের সঙ্গে তার কণ্ঠ জড়িয়ে আসছিল। আমি বললাম, “আমি একটা কথা বলব।” “বলো,” সে বলল। “মায়েরা আমাকে দেখাতে চায়—” বাকিটা শেষ করতে পারলাম না। ওপাশে একটু নীরবতা, তারপর সে বলল, “ভালোই তো। তুমিই তো বলেছিলে জীবন সব সময় গল্পের মত সাজানো থাকে না।” আমি চুপ করে রইলাম। সে আস্তে বলল, “আমি তোমার বলতে না পারা কথাগুলো বুঝি, আরিফ। কিন্তু বুঝতে পারলেই তো বাস্তব বদলে যায় না।”

“তুমি কি—” আমি থামলাম। “আমি কী চাই?” ওর কণ্ঠে একটা কাঁচের মতো শব্দ। “আমি চাইতাম আমরা নদীর ধারেই থাকি, প্রতিদিন বিকেলে হাঁটি, তুমি তোমার কাজের কথা বলো, আমি আমার কবিতার কথা বলি। কিন্তু আমি জানি, তোমার বাবার চোখে তুমি দায়িত্ব, আর আমার বাবার চোখে আমি অনিশ্চয়তা। আমাদের ভালোবাসা দুই পরিবারের হিসেবের খাতায় কোনো পাতাই পায় না।”

আমি বলতে চেয়েছিলাম—চলো, আমরা চেষ্টা করি; আমরা দাঁড়িয়ে থাকি, ভিড়ের বিপরীতে। কিন্তু আমার কণ্ঠে কোনো শক্তি ছিল না। রাতে বৃষ্টি পড়ছিল, রুমের টিউবলাইট ঝিমিয়ে আসছিল। আমি বললাম, “তুমি সুখে থেকো, নবনী।” ও বলল, “তুমি থাকো।”

সেই ছিল আমাদের শেষ দীর্ঘ কথা। তারপর থেকে আমরা ছোট ছোট খোঁজ-খবর নিয়েছি—ফলাফল কেমন হলো, বাবার শরীর কেমন। কিন্তু কোনোদিন কথা বলিনি “আমাদের” নিয়ে। আমার ঢাকা শহরের সকালগুলো বদলে গেল—মেট্রোরেলের কাঁচে যেদিন আমার মুখ দেখা যায়, মনে হয় পাশে আরেকটা মুখ—যার হাসি শান্ত। কিন্তু সেটা কল্পনা।

একদিন খবর পেলাম—নবনীর বাবা মারা গেছেন। আমি বরিশাল গেলাম। জানাজায় দূর থেকে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখা-সাক্ষাৎ হলো না, আমার যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ফিরতি স্টিমারে বসে যত দূর নদী, তত দূর আমার ভেতরটা। মনে হলো আমার বুকের ভেতর একটা ঘর ছিল, সেখানে একটা জানালা আছে, জানালায় মশারির ভাঁজ, আর বাতাসে নুনের গন্ধ। জানালাটা কেউ আস্তে করে বন্ধ করে দিয়েছে।

তার কিছুদিন পর আমার নিজের বাড়িতে সম্পর্কের কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। মেয়েটি ভালো ছিল, পড়াশোনা করেছে, কথা বলে মিষ্টি করে, পরিবারের সঙ্গে অত্যন্ত ভদ্র। আমি একদিন ওকে বললাম, “আমি খুব বেশি কথা বলি না।” ও হাসল, “আমি বুঝতে পারি।” আমার মাথার ওপর যেন একটা ছাদের অদ্ভুত শব্দ। আমি মন দিয়ে বোঝাতে পারিনি, শব্দটা আসলে কোথা থেকে আসে।

আমাদের বিয়েও হয়ে গেল। মানুষের জীবন এগিয়ে যায়—বসে থাকে না। আমি অফিসে প্রতিদিন যাই, ফিরে আসি, রান্নাঘরের সিঙ্কে প্লেট রাখা, খবরের কাগজ, ফ্ল্যাটের বারান্দায় বাতাস। আমার এই নতুন জীবনে কোনো অভিযোগ নেই, হয়তো খুশিও আছে। কিন্তু কিছু রাত থাকে—যেদিন ঘুম আসে না। টেবিলে বসে পুরনো ডায়েরি খুলে দেখি একটা পাতা—বরিশালের চায়ের দোকানের রসিদ, যেখানে খানে লেখা আছে, “চিনি ছাড়া—১ কাপ”। আমি বুঝি না কীভাবে এই ধরনের তুচ্ছ জিনিস মনে থেকে যায়।

বছর কয়েক পরে এক রাতে মেসেঞ্জারে মেসেজ পেলাম—”আরিফ, তুমি কি ব্যস্ত?” নামটা দেখেই আমার বুক থামল। নবনী। আমি লিখলাম, “না। বলো।” ও লিখল, “আমি ঢাকায়। হসপিটালে ছিলাম। এক আত্মীয় ভর্তি। ভাবলাম তোমাকে একটা কথা বলব—আসলে, মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না।” আমি কয়েক সেকেন্ড বসে রইলাম। লিখলাম, “তুমি কোথায়?” ও একটা ঠিকানা দিল—ধানমন্ডির একটা হাসপাতালের পাঁচ তলার বারান্দা।

আমি গিয়ে দাঁড়ালাম। বারান্দায় অল্প আলো, ও কাঁচের রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে। চুল বাঁধা, ওড়না কাঁধে ঝুলছে। আমাকে দেখেই হাসল—ওই পুরনো, শান্ত হাসি। আমরা পাশপাশি দাঁড়ালাম। প্রথম যে কথা বললাম, সেটা অন্য কোনো কিছু নয়—”তুমি কেমন আছ?” ও বলল, “ভালই আছি। তোমার?” আমি বললাম, “ভাল।” ও একটু থেমে বলল, “তুমি বিয়ে করেছ?” আমি মাথা নাড়লাম। “ভালো?” “হ্যাঁ, ভালো।” ও হাসল। বৃষ্টি হচ্ছিল না, কিন্তু বাতাসে বৃষ্টির ভেজা গন্ধ।

ও বলল, “তুমি কি কখনো ভাবো—আমাদের কথা?” আমি জবাব দিলাম না। অনেকক্ষণ নীরবতা। তারপর ও বলল, “আমি একদিন ভাবছিলাম, আমরা যদি তখন দাঁড়িয়ে যেতাম, যদি বাবা-মাকে বলতাম, কি হতো? হয়তো তুমি আমাকে দোষ দিতে, হয়তো আমি তোমাকে। হয়তো আমরা আলাদা কোনো কারণে ভেঙে যেতাম।” আমি বললাম, “হয়তো।” “কিন্তু একটা জিনিস জানো,” নবনী বলল, “আমার মনে হয়, আমরা নিজেদের ভুলতে পারিনি বলে, আমরা অন্যদের বেশি ভালো করে বুঝতে শিখেছি।” আমি তাকিয়ে থাকলাম। “যেটা পাওয়া যায় না, সেটা অনেক সময় মানুষকে বড় করে দেয়।”

ও হেসে মাথা নিচু করল। “আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।” “বলো,” আমি বললাম। “তুমি আমাকে কোনোদিন কিছু বলোনি। কিন্তু আমি জানতাম। বলাটা দরকার ছিল না।” আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল কিনা জানি না—হয়তো ছিল, আমি চোখের কোণা মুছে নিলাম। “আর তুমি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। “আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় জানালার পাশে দাঁড়াই,” নবনী বলল, “বারান্দার নিচে বাচ্চারা খেলে, কখনো মনে হয় তুমি পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ। তারপর মনে পড়ে, তুমি তো ঢাকার অন্য প্রান্তে।” আমরা দুজনেই হাসলাম। এক ধরনের সান্ত্বনার হাসি—যেন কেউ বলছে, ঠিক আছে, কষ্টটা আছে, কিন্তু আমরা বেঁচে আছি।

সেদিন বিদায় নেওয়ার সময়, ও একটা কাগজ দিল। ভাঁজ করা। আমি বললাম, “এটা কী?” “চা-দোকানের রসিদ,” ও বলল, “চিনি ছাড়া। তোমার কাছে যদি থাকে, দুইটা একসাথে থাকবে।” আমি কাগজটা নিলাম, ভাঁজটা খুললাম না। “তুমি সুখে থেকো,” আমি বললাম। “তুমিও,” ও বলল। আমরা হাত মেলালাম না, কোনো আলিঙ্গন নয়—শুধু একটা আলোচিহ্ন মনে রেখে চলে এলাম।

এরপর অনেকদিন কোনো বার্তা নেই। আমার জীবনের গল্প ঠিক ফরাশগোলার রাস্তা দিয়ে চলে যায়—মন্থর, ভিড়, হর্ন, সামনের গাড়ির পিছনের লাইট, লাল-সবুজ। কিন্তু ওর দেওয়া কাগজটা আমি খোলার সাহস পেলাম না। কারণ জানতাম, ভাঁজটা খুললেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে একটা ঘ্রাণ, যেটাকে শব্দ দিয়ে ধরতে পারা যায় না।

দুই বছর পর হঠাৎ একটি বিকেলে মেইল এল—subject: “জানালার আলো”। নবনী লিখেছে, “এটা কোনো অভিযোগের চিঠি না, না কোনো অনুরোধ। শুধু জানাতে চাই—মাঝে মাঝে খারাপ দিনগুলো আসে। সেই দিনগুলোতে আমি জানালার গ্রিলে মাথা রেখে ভাবি, কেউ কি আছে যে বুঝবে? তারপর মনে পড়ে, আছে—কোনো এক শহরে, কোনো এক ঘরে, কোনো এক মানুষ, যে অন্য কাউকে ভালোবেসে বেঁচে আছে, তবুও আমার জন্য একটা ছোট জায়গা রেখে দেয়। সেই জায়গাটুকুতে আমি মাঝে মাঝে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদি। তুমি কোনো উত্তর দিও না। শুধু জান, এই পৃথিবীতে একটা ভালোবাসা আছে, যেটা কেউ জানে না, কিন্তু তবু বেঁচে থাকে।”

আমি মেইলটা পড়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বাইরে বৃষ্টি নামছিল। টেবিলে রাখা সেই ভাঁজ করা কাগজটা খুললাম। দেখলাম—সত্যিই চায়ের দোকানের বিল। খাতা থেকে ছেঁড়া। উপরে লেখা “চিনি ছাড়া—১ কাপ”। নিচে হালকা পেন্সিলে লেখা, “যেখানে কথা বলি না, সেই জায়গাতেই সবচেয়ে বড় কথা থেকে যায়। — ন”

আমি কাগজটা বুকের কাছে ধরলাম। কোনো শব্দ হলো না। তারপর ধীরে ধীরে ড্রয়ারে রেখে দিলাম। আমার পাশে জীবন ছিল—রান্নাঘরে বাসন ধোয়ার শব্দ, টিভিতে খবর, দরজায় কারা যেন হেসে-খেলে যাচ্ছে। আমি জানি, এই জীবনের কোনো অংশে আমি বেঈমানি করছি না। আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি—এটা সত্য, তার সবকিছুর যত্ন নিই, তার হাসি আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবু স্বীকার করি, আমার ভেতরে একটি জানালা আছে—যেটা নবনীর জন্য খুলে থাকে। এসব কথা বললে কেউ হয়তো বলবে, এটা অন্যায়। কিন্তু কিছু অনুভূতি আছে, যেগুলোকে তুমি সংজ্ঞায় আটকে রাখতে পার না। যেমন কোনো নদীকে বলো—শুধু বাঁধের মধ্যে দিয়ে যাও, নদী উত্তর দেবে—আমার ভিতরে জোয়ার-ভাটা আছে।

কিছুদিন পর খবর পেলাম—নবনী বিয়ে করেছে না। মানুষজন বলল, “এত ভালো মেয়ে, বিয়ে হলো না কেন?” কেউ জানে না, কেউ জানতেও চায় না। আমি কোনোদিন ওকে জিজ্ঞেস করি নি। কারণ আমার মনে হয়, এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করাটা আমাদের নীরবতার প্রতি অন্যায় হয়ে যাবে।

বছরগুলো আরেকটু এগোল। আমার ছুটিতে একদিন আমরা কক্সবাজার গেলাম—আমি, আমার স্ত্রী, আর কয়েকজন বন্ধু। সাগরের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, কোনো সম্পর্কের শেষ মানে ঠিক কী? হাত ছাড়া করা? নাকি মনে মনে একটা জায়গা ছেড়ে রাখা—যেখানে কেউ এসে বসতে পারবে? সন্ধ্যায় আকাশে যে রঙটা ছড়িয়ে পড়ে, তা কি রাতকে শেষ করে—না কি দিনকে ধরে রাখে? আমি বুঝি না। শুধু জানি, ঢেউ যখন আসে, তার ভিতরে বহু দূরের পাহাড়ের গন্ধ থাকে। আমি হাসলাম—নিজের এই ভাবুকতা নিয়ে কখনো কখনো নিজেকেই বিরক্ত লাগে। কিন্তু ওই মুহূর্তে মনে হলো, দূরে কোনো শহরে, কোনো জানালার গ্রিলে হেলান দিয়ে একটা মেয়ে হাসছে। সে জানে, আমি জানি—এই পৃথিবীতে আমাদের জন্য একটা নীরব জায়গা আছে।

ঢাকায় ফিরেই ডাকবাক্সে দেখি একটা খাম। ভিতরে একটা ছোট্ট কার্ড: “বরিশালের নদীর হাওয়া, জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকুক। — ন” কোনো ঠিকানা নেই। আমি কার্ডটা টেবিলে রাখলাম। হঠাৎ মনে হলো, এমন অনেক কার্ডই হয়তো আমরা পাই—কাউকে না জানিয়ে, কারো জন্য না রেখেও—আমাদের ভিতরের কার্ডরা। সেগুলোই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। আমরা এক জীবন কাটাই অন্য কাউকে ভালোবাসতে শিখে—সেই ভালোবাসা যদি পাওয়া না-ও যায়, তবু তা আমাদের মানুষ করে।

এখন রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। আমি টেবিলল্যাম্পটা নিভিয়ে জানালার কাছে যাই। নিচে রাস্তার লাইট। দূরে কোনো কুকুর ডাকছে। আমি ধীরে ধীরে পর্দা একটু সরাই। কাঁচে আমার মুখ ভেসে ওঠে, আর পাশে আরেকটা—যেটা নেই। আমি আস্তে বলি, “নবনী, ভালো থেকো।” আমার কণ্ঠে কোনো নাটক নেই, শুধু একরকম শান্তি—যেন অনেকদিন পর একটা ভার নামিয়ে রাখলাম।

কিছু ভালোবাসা থাকে, যাদের কোনো সমাপ্তি নেই। তারা না পাওয়া বলে নয়—তারা অসমাপ্ত বলেই বেঁচে থাকে। সমাপ্তির দরকার তাদের হয় না। তারা জানালার আলো হয়ে থাকে—যখন ঘরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখনো ছোট্ট এক বৃত্ত আলোর মতো। তুমি হাত বাড়ালেই সেই আলো তোমার কপালে এসে পড়ে। তুমি জেগে ওঠো না—কেবল একটু গভীর ঘুমে ঢুকে পড়ো।

আমি জানি, আমার জীবনের গল্পে মানুষ থাকবে—যাদের কাছে আমি দায়বদ্ধ, যাদের ভালোবাসায় আমি প্রতিদিনের সকাল শুরু করি। তাদের ভালোবাসা পূর্ণ, প্রাপ্তি-ভরা। আর কিছুটা দূরে, এক কোণে, এক নীরব জানালা খোলা থাকবে—সেখানে নবনী দাঁড়িয়ে থাকবে না, শুধু তার নাম থাকবে, তার দেওয়া ছোট ছোট রসিদ, কার্ড, মেইলের কথারা থাকবে। আমি কোনোদিন ওকে আর লিখব না। লিখলে হয়তো সবকিছুর সৌন্দর্যটাই হারিয়ে যাবে। আমরা যে নীরবতা বেছে নিয়েছি—তার দায় আমাদের; আবার তার আশ্রয়ও আমাদের।

রাত ভেঙে গেলে ভোরের আজান হবে। আমি উঠে নামাজ পড়ব, তারপর অফিসের পোশাক পরব, ব্যাগে ল্যাপটপ রাখব। মেট্রোরেলের পাটাতনে দাঁড়িয়ে যখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকাব, শহর পিছিয়ে যাবে। তখন মনে হবে—কিছু কিছু সম্পর্ক ঠিক ট্রেনের মতো—পাশ দিয়ে চলে যায়, তুমি হাত বাড়িয়ে ধরো না। কারণ জানো, ধরতে গেলেই হয়তো পড়ে যাবে। বরং পাশে দাঁড়িয়ে তুমি শুধু দেখো—কত সুন্দর তাদের চলা। তারা তোমার হয় না, কিন্তু তোমার চোখ ভরে দেয়।

ভালোবাসা কি প্রাপ্তির নাম? আংশিক। কিন্তু আরও বেশি, ভালোবাসা হলো এমন একটা জায়গা—যেখানে তুমি নিঃশব্দে বসে কারো জন্য ভালো থাকাকে প্রার্থনা করো। তোমার প্রার্থনা যদি পৌঁছায়, তাহলে তুমি যা পাওনি, সেটাও তুমি পেয়েছ। এই বিশ্বাসটাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নবনীকে নয়—একটা অনুভূতিকে। সেই অনুভূতিটাই আমার এই গল্পের নায়ক।

কোনো দিন যদি তুমি বরিশালের হাসপাতালের ওই বারান্দা দিয়ে হাঁটো, ভেজা গন্ধে মাথা ঝিমিয়ে যায়, টিনের ছাউনি থেকে টপটপ করে পানি পড়ে—তুমি হাঁটতে হাঁটতে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াও। চিনি ছাড়া এক কাপ চা নিও। ধোঁয়া উঠবে কাপের মুখে। সেই ধোঁয়া চোখে এসে ধরবে। তুমি বুঝবে, সারা পৃথিবীতে কিছু ভালোবাসা আছে—যাদের নাম নেই, ঠিকানা নেই, তারা শুধু ধোঁয়ার মতো ভেসে থাকে। তবু তারা আছে। সেই থাকার ভেতরেই তো আমরা বেঁচে উঠি।

উপসংহার

জীবনের প্রতিটি কষ্টের পেছনেই লুকিয়ে থাকে নতুন শুরুর ইঙ্গিত। কষ্টের গল্প আমাদের শেখায় ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস আর ভালোবাসার মূল্য। কষ্ট মানুষকে ভাঙে না—বরং নতুন করে গড়ে তোলে। তাই যারা কষ্টে আছে, তারা যেন মনে রাখে—প্রতিটি অন্ধকার রাতের পরেই আসে নতুন ভোর। জীবনের কষ্ট যতই গভীর হোক না কেন, সেটাই একদিন তোমার সাফল্যের গল্প হয়ে উঠবে।

Ayan

আয়ান, বাংলা ভাষার প্রেমে পড়া একজন সৃজনশীল লেখক, যিনি মনোমুগ্ধকর ক্যাপশন, স্ট্যাটাস ও উক্তি লিখে পাঠকদের মন জয় করেন। শব্দের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ করাই তাঁর অন্যতম নেশা। ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা, বন্ধুত্ব, হাসি-মজা—সব ধরনের ক্যাপশন লেখার ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা অসাধারণ। পছন্দের বিষয়: ক্যাপশন রচনা, সাহিত্য, উক্তি ও জীবন দর্শন।

Leave a Comment