একজন প্রকৃত শিক্ষক কেবল পাঠ্যবই পড়ান না, তিনি জীবন গড়ে তোলেন। আমাদের জীবনের প্রতিটি সফলতার পেছনে কারও না কারও শিক্ষার ছাপ থাকে—আর সেই মানুষটিই হচ্ছেন শিক্ষক। তাঁদের স্নেহ, শাসন, প্রেরণা, আর ধৈর্য আমাদের গড়ে তুলেছে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে। ছাত্রজীবন শেষ হলেও শিক্ষককে নিয়ে সেই মধুর স্মৃতিগুলো কখনো ভোলা যায় না। নিচে তুলে ধরা হলো হৃদয়স্পর্শী স্মৃতিচারণ, যা আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেই শ্রদ্ধায় ভরা দিনগুলোয়।
শিক্ষককে নিয়ে বড় আবেগঘন স্মৃতিচারণ:
আমার জীবনের সবচেয়ে গঠনমূলক দিনগুলোতে পাশে ছিলেন একজন মানুষ—আমার শিক্ষক। তিনি শুধু অঙ্ক শেখাননি, জীবনকে সহজভাবে দেখার চোখটাও খুলে দিয়েছেন।
মনে পড়ে, একবার পরীক্ষায় খারাপ করেছিলাম। সবাই বকাঝকা করলেও আমার সেই শিক্ষক বলেছিলেন, “হার মানিস না, এখান থেকেই শুরু কর।” তাঁর সেই কথাটাই আমার জীবন বদলে দিয়েছিল।
শিক্ষক মানে শুধুই শ্রেণিকক্ষ নয়, স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেওয়া একটুখানি উৎসাহ, কিংবা ক্লাস শেষে মাথায় হাত বুলিয়ে বলা—”তুই পারবি”। সেইসব মুহূর্ত আজো গায়ে কাঁটা দেয়।
আমার এক শিক্ষক ছিলেন, যিনি প্রতি সপ্তাহে আমাদের জীবনের ছোট ছোট সমস্যা নিয়ে কথা বলতেন। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক নন, ছিলেন অভিভাবক, বন্ধু, পথপ্রদর্শক।
মনে পড়ে, একটি গল্প প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ভয় পাচ্ছিলাম। আমার শিক্ষিকার বলা একটি লাইন ছিল—”তুমি তোমার ভয়ের চেয়ে বড়।” সেই দিন থেকে আমি আর কখনো পেছনে তাকাইনি।
আমাদের ইংরেজি স্যারের হাসিমুখে ক্লাস শুরু করার ভঙ্গিটা আজও মনে পড়ে। তাঁর শেখানো প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আমার জীবনের সাথে গেঁথে আছে।
ছাত্রজীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে যখন ভেঙে পড়ছিলাম, তখন একজন শিক্ষক চুপচাপ এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আমি আছি, ভয় পাস না।” সেই সাহসটাই আজও টিকে থাকার প্রেরণা।
আমার মনে আছে, যখন আমি প্রথম শ্রেণিতে ভয় জড়োসড়ো হয়ে ক্লাসে ঢুকেছিলাম, আমার শিক্ষক স্নেহভরে আমার হাত ধরে পাশে বসিয়েছিলেন। সেই সামান্য স্পর্শ আমার ভেতরের সব ভয় দূর করে দিয়েছিল।
সেই অঙ্কের শিক্ষককে আমার আজও মনে আছে, যিনি জটিল সমস্যাগুলো এত সহজে বুঝিয়ে দিতেন যে মনে হতো যেন সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার। তাঁর শেখানোর কৌশল আমার ভিত শক্ত করে দিয়েছিল।
একদিন ক্লাসে একটি ভুল উত্তর দেওয়ায় আমি খুব লজ্জিত হয়েছিলাম, কিন্তু আমার বাংলা শিক্ষক এমনভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে ভুল থেকে শেখাটাও একটা মূল্যবান শিক্ষা। তাঁর সেই কথা আজও আমার মনে গেঁথে আছে।
আমাদের ইতিহাসের শিক্ষক ক্লাসে এমনভাবে গল্প বলতেন যে মনে হতো আমরা যেন সেই সময়ের সাক্ষী। তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থাপনা ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলত।
আমার সেই বিজ্ঞান শিক্ষকের কথা ভুলব না, যিনি আমাদের হাতে-কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে উৎসাহিত করতেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় বিজ্ঞানের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মেছিল।
স্কুলের শেষ দিনে যখন আমরা শিক্ষকের কাছে বিদায় নিতে গিয়েছিলাম, তাঁর চোখের জল দেখে আমরাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। সেই মুহূর্তটি বুঝিয়েছিল শিক্ষকের হৃদয়ে ছাত্রদের জন্য কতটা ভালোবাসা থাকে।
কলেজে আমার সাহিত্য শিক্ষক প্রতিটি কবিতা ও গল্পের গভীরে প্রবেশ করে তার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝিয়ে দিতেন। তাঁর সেই বিশ্লেষণ আমার চিন্তাভাবনার দিগন্ত প্রসারিত করেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অধ্যাপককে আমার সবসময় মনে থাকবে, যিনি শুধু সিলেবাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতেন না, বরং জীবনের নানা দিক নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করতেন। তাঁর পরামর্শ আমার জীবন গঠনে অনেক সাহায্য করেছে।
আমার মনে আছে, একবার একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আগে আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল, কিন্তু আমার শিক্ষক আমাকে সাহস জুগিয়েছিলেন এবং আমার সাফল্যের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।
আজ যখন আমি জীবনের কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ি, তখন আমার সেইসব শিক্ষকদের কথা মনে পড়ে, যাঁরা আমাকে প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করতে শিখিয়েছেন। তাঁদের দেখানো পথ আজও আমার পাথেয়।
শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হওয়ার দিনগুলো যেন ছিল একেকটা জীবনের পাঠশালা। প্রতিদিন শুধু বই নয়, তিনি শেখাতেন কীভাবে ভালো মানুষ হতে হয়।
ছোট্ট একটা শাস্তি পেয়েছিলাম ভুলের জন্য, কিন্তু পরে শিক্ষক নিজে এসে বলেছিলেন, “তুমি যা করেছো, তা থেকে শিখে এগিয়ে যাও—এটাই সফলতার প্রথম ধাপ।” এমন মানবিকতা খুব কমই দেখা যায়।
শিক্ষক যখন শুধু একজন চাকরিজীবী নয়, বরং একজন চরিত্র নির্মাতা হন, তখন তাঁর স্পর্শে একজন ছাত্র সত্যিকার অর্থেই মানুষ হয়ে ওঠে। আমার শিক্ষক ছিলেন তেমনই একজন আলোকবর্তিকা।