শিয়ালের গল্প বাংলা সাহিত্য ও লোককথার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেখানে বুদ্ধি, চালাকি আর কৌশলের চমৎকার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই গল্পগুলো শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং এর ভেতরে লুকিয়ে থাকে বাস্তব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক শিক্ষা। ছোটবেলায় আমরা যারা শিয়াল ও কাক, শিয়াল ও বকের গল্প শুনেছি, তারা জানি—শিয়াল চরিত্রটি সাধারণত চতুর, মজার ও চিন্তাশীল।
এই গল্পগুলো শিশুদের কল্পনাশক্তি বাড়ায়, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য শেখায় এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার বুদ্ধিমত্তা গড়ে তোলে। এই লেখায় আমরা শেয়ার করছি কিছু জনপ্রিয় ও শিক্ষামূলক শিয়ালের গল্প, যা শিশু-কিশোরসহ সব বয়সী পাঠকের মনে আনন্দ ও জ্ঞান দুই-ই যোগাবে।
এখানে আপনি পাবেন:
শিয়ালের গল্প ১: চাঁদে যাবার শিয়াল
একদিন শিয়াল বনে হাঁটছে, আর নিজের মনেই ভাবছে—
“আমি কত চালাক! এই বনের সব প্রাণী আমাকে ভয় পায়। কিন্তু যদি আমি কিছু অসাধারণ করতে পারি, তাহলে সবাই আমাকে শ্রদ্ধা করবে।”
হঠাৎ সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে—আকাশে বিশাল একটা পূর্ণচাঁদ। তার মনে হলো,
“যদি আমি চাঁদে যেতে পারি, তাহলে আমি হবো পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত শিয়াল!”
সে ঘোষণা দিল, “বন্ধুরা! আমি কাল চাঁদে যাবো!”
খরগোশ, কাঠবিড়ালি, কাক—সবাই হাসতে লাগল।
“তুই চাঁদে যাবি? কীভাবে?”
শিয়াল গম্ভীর মুখে বলল,
“এই কাজ সহজ নয়। আমি রাতভর প্রস্তুতি নেব। আর সকালে সূর্যের আগেই চাঁদের সিঁড়ি খুঁজে বের করব।”
রাতে সে একটা বড় গাছের নিচে বসে ছাই আর পাতার গুঁড়ো দিয়ে নিজেই একটা “জাদুর পাউডার” বানাল। বলল,
“এই পাউডার ছিটিয়ে দিলেই আমি উড়তে পারব!”
পরদিন ভোরে সবাই যখন জড়ো হয়েছে শিয়ালকে চাঁদে যেতে দেখবে বলে, তখন সে গাছের ওপর উঠে দাঁড়াল, চোখ বন্ধ করে পাউডার ছিটিয়ে দিল আর বলে উঠল—
“জাদু জাদু হোক, আমাকে চাঁদে নিয়ে যাক!”
…আর সঙ্গে সঙ্গে গাছ থেকে পা পিছলে নিচে পড়ে গেল! ধপাস!
সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল। শিয়াল ব্যথা পেয়েছে, কিন্তু সে লজ্জা চেপে বলল,
“আসলে আমি চাঁদের দিকটা ভালো বুঝতে পারিনি, দিক ঠিক থাকলে ঠিকই পৌঁছে যেতাম।”
গল্পের শিক্ষা:
- অযৌক্তিক অহংকার মানুষকে হাস্যকর করে তোলে।
- নিজেকে বড় দেখাতে গিয়ে মিথ্যে বললে, শেষে নিজেরই ক্ষতি হয়।
- বাস্তবতা মেনে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
শিয়ালের গল্প ২: শিয়াল ও বক – বুদ্ধির বদলা
একদিন শিয়াল হাঁটতে হাঁটতে ভাবল,
“এই বকের ঠোঁটটা অনেক লম্বা। এমন জিনিস দিয়ে খাওয়া যায় না! আমি ওকে একদিন একটু ঠকাই দেখি।”
সে বককে ডাকল,
“বন্ধু বক, আজ আমি দারুণ এক খাবার রান্না করেছি। তোমার জন্য বিশেষ নিমন্ত্রণ।”
বক খুশি হয়ে বলল,
“ওহ্, দারুণ! আমি বিকেলেই তোমার বাড়ি আসছি।”
বিকেলে বক এলো। শিয়াল সুন্দর করে খাবার রান্না করল—খুব সুস্বাদু খিচুড়ি, কিন্তু তা পরিবেশন করল একেবারে চ্যাপ্টা থালায়।
শিয়াল জিভ চাটতে চাটতে খেতে লাগল। কিন্তু বক তার লম্বা ঠোঁট দিয়ে পাতলা থালার খাবার কিছুতেই তুলতে পারল না। খুব চেষ্টা করেও কিছু খেতে পারল না।
শিয়াল বলল,
“তুমি বুঝি আমার রান্না পছন্দ করো না?”
বক চুপচাপ চলে গেল। শিয়াল মনে মনে হাসল,
“বোকা বক! কী বুদ্ধিতে ফেললাম!”
পরদিন বক বলল,
“বন্ধু শিয়াল, এবার আমার বাড়িতে এসো। আমি তোমার জন্য মাছ রান্না করেছি।”
শিয়াল ছুটে গেল! সত্যিই দারুণ সুস্বাদু গন্ধ! কিন্তু বক খাবার পরিবেশন করল লম্বা সরু গলাযুক্ত এক কলসিতে।
বক তার লম্বা ঠোঁট ঢুকিয়ে আরাম করে খেল, আর শিয়াল বারবার মুখ ঢোকাতে গিয়ে আটকে গেল।
শেষে শিয়াল লজ্জা পেয়ে বলল,
“তুই তো আমায় একইভাবে ঠকিয়ে দিলি!”
বক শান্তভাবে বলল,
“শুধু নিজের সুবিধা দেখে যে কাজ করে, সে অন্যের অবস্থার মূল্য বুঝতে পারে না।”
গল্পের শিক্ষা:
- অন্যকে যেমন আচরণ করো, একদিন তেমনটাই ফিরে আসবে।
- নিজে যেমন কষ্ট দাও, তেমন কষ্ট পেলে বোঝা যায় ভুলটা কোথায়।
- ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের ভিত্তি হলো—বিনয় ও পারস্পরিক সম্মান।
শিয়ালের গল্প ৩: রাজা হতে চেয়েছিল শিয়াল
একদিন গভীর জঙ্গলে প্রাণীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। পুরনো সিংহ রাজা বৃদ্ধ হয়ে পড়েছে—রাজ্যের জন্য দরকার নতুন একজন রাজা।
সব পশু জড়ো হয়ে আলোচনায় বসলো—কে হবে নতুন রাজা?
শিয়াল তখন চুপচাপ একটা গাছের নিচে বসে নিজের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল,
“আমি তো দেখতে খুবই বুদ্ধিমান, কথা বলি মিষ্টি, আর চালাকিও কম না… রাজা হওয়া কি খুব কঠিন?”
পরদিন সকালে সে সুন্দর করে গা পরিষ্কার করল, লেজে ফুল গুঁজে, মাথায় মুকুটের মতো পাতা পরে এসে বলল,
“আমি ঘোষণা করছি, আমি হবো তোমাদের নতুন রাজা!”
সব পশু অবাক! বাঘ বলল,
“তুই রাজা হবি? তোর তো দাঁত নেই, গর্জন নেই, সাহস নেই!”
শিয়াল হেসে বলল,
“রাজত্বে গর্জনের দরকার নেই, দরকার বুদ্ধি। আমি তোমাদের চালিয়ে নিয়ে যাবো উন্নতির পথে।”
অনেক প্রাণী মেনে নিল, কেউ হাসল, কেউ চুপ করে রইল।
শিয়াল রাজা হয়ে গেল। সে প্রথমেই বলল,
“প্রতিদিন সকালের খাবার আগে রাজাকে দিতে হবে। এরপর সবাই খেতে পারবে।”
সে প্রতিদিন সবার খাবার থেকে ভাগ নিয়ে খেতে লাগল। নিজে খাচ্ছে মধু, অন্যদের দিচ্ছে শুকনো পাতা।
একদিন খরগোশ, বানর, হরিণ সবাই মিলে পরিকল্পনা করল।
পরদিন তারা শিয়ালকে বলল,
“হে রাজা, আজ আমরা রাজমুকুট খুঁজে পেয়েছি এক গাছের নিচে। আপনি চলুন, সেটা মাথায় তুলেই পূর্ণ রাজা হবেন।”
শিয়াল গিয়ে দেখল, নিচে এক গর্তে সোনালী পাতায় মোড়া কিছু একটা। সে লাফ দিয়ে ঝাঁপ দিল গর্তে।
গর্তটি আসলে একটি পুরনো ফাঁদ। ভিতরে পড়তেই তার লেজ আটকে যায়, আর গায়ে কাঁটার ব্যথা লাগে।
সব পশু উপরে দাঁড়িয়ে হেসে বলল,
“যে অন্যের উপর শাসন করতে চায়, সে আগে শিখুক কেমন করে সবার দায়িত্ব নিতে হয়!”
শিয়াল চুপ করে গেল। আর কখনো রাজা হওয়ার কথা বলল না।
গল্পের শিক্ষা:
- অহংকার করে নেতৃত্ব চাওয়া নয়, দায়িত্বশীলতাই সত্যিকারের নেতৃত্বের মূল।
- নিজের স্বার্থে রাজা হতে চাইলে, শেষ পর্যন্ত প্রতারণা ফাঁস হয়ে যায়।
- সবার আস্থা অর্জন করেই নেতৃত্ব পাওয়া উচিত, জোর করে নয়।
চালাক শিয়ালের গল্প
একদিন শিয়াল বন থেকে ঘুরে ফিরছে। হঠাৎ সে দেখতে পেল, এক বিশাল সিংহ একটি হরিণ শিকার করে ফেলেছে। হরিণটা খুব বড়, গায়ে মাংস টসটসে। শিয়ালের জিভে পানি এসে গেল।
সে ভাবল,
“সিংহ তো একা এতটা খেতে পারবে না। যদি একটু চালাকি করা যায়, কিছু মাংস পাওয়া যেত!”
শিয়াল সোজা সিংহের সামনে গিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“মহামান্য সিংহরাজ! আপনি একা এই বিশাল হরিণ খেয়ে ফেলবেন? এটা তো রাজ্যের অন্য পশুদের জন্য অবিচার হবে। তাই আমি সুস্থ বুদ্ধি দিয়ে শিকার ভাগ করে দিচ্ছি।”
সিংহ বলল,
“ভাগ? দেখাই তো যাক তুমি কতটা বিচারজ্ঞানসম্পন্ন!”
শিয়াল বলল,
“এই হরিণের এক পা আপনার, এক পা আমার, এক পা রাজার রাজভাণ্ডারে, আর এক পা প্রজাদের জন্য। মাথা যাবে শিকার বিভাগে, আর লেজ দিয়ে পরিষ্কার কাজ করা হবে। তাই পুরোটা আলাদা করে নেয়া দরকার।”
সিংহ রেগে গর্জে উঠল,
“তুই তো আমাকে দিলি এক পা! বাকিটা ভাগ করে দিলি?”
এ কথা শুনে শিয়াল চট করে সিংহের পায়ে পড়ে বলল,
“ক্ষমা করবেন রাজা। আমি তো পরীক্ষা নিচ্ছিলাম আপনার ধৈর্যের! আপনি যদি রেগে যান, তাহলে তো কেউ শেয়ার করতে চাইবে না। তাই দেখলাম আপনি কত সহনশীল।”
সিংহ কিছুটা শান্ত হয়ে বলল,
“তুই খুব চালাক… কিন্তু মনে রাখিস, বেশি চালাকির শেষ ভালো হয় না।”
শিয়াল মাথা নিচু করে হাসি চেপে ফিরে গেল, আর ভাবে,
“সিংহ তেলেবেগুনে জ্বলে, আর আমি চালাকি করে মাংসের ভাগ বুঝে নিই—এই তো আমার কাজ!”
গল্পের শিক্ষা:
- উপস্থিত বুদ্ধি ও কথার চাতুর্য অনেক সময় বিপদ থেকেও রক্ষা করতে পারে।
- চালাকি করতে হয় হিসেব করে, না হলে তা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
- বড়দের সঙ্গে কথা বলার সময় সতর্কতা ও বিনয় বজায় রাখা চালাকির অন্যতম রূপ।
হরিণ ও শিয়ালের গল্প
এক সময়ের কথা, একটি গভীর বনে এক শান্ত-শিষ্ট হরিণ বাস করত। সে ছিল খুবই সদাচারী এবং নিরীহ। অন্যদিকে, সেই বনে এক চালাক শিয়ালও থাকত, যার স্বভাব ছিল ধূর্ততা এবং ফাঁদ পেতে অন্যকে ঠকানো।
একদিন হরিণটি জঙ্গল থেকে ঘুরে এসে শীতল ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিল। তখন শিয়ালটি এসে বলল,
— “বন্ধু হরিণ, পাশের পাহাড়ের ওপারে এক দারুণ ফলের বাগান আছে। সেখানে চল না, মজাদার ফল খেয়ে আসি!”
হরিণটি একটু চিন্তা করল। সে জানত শিয়াল অতটা নিরীহ নয়। তবুও ফলের লোভে রাজি হয়ে গেল। দুজন মিলে রওনা হল।
পথে একটি সংকীর্ণ খাল পড়ল। শিয়ালটি বলল,
— “তুমি আগে যাও, আমি পেছনে আসছি।”
হরিণটি যখন খাল পার হচ্ছিল, শিয়াল পিছনে থেকে চিৎকার করে বলল,
— “ওরে বাঘ মামা! হরিণ এসেছে, ধরো!”
বনের বাঘ এই ডাক শুনে ছুটে এসে হরিণটিকে ধরল। হরিণ চিৎকার করতে লাগল:
— “শিয়াল আমার বন্ধু, ও-ই আমাকে নিয়ে এসেছে!”
বাঘ রেগে গিয়ে বলল, “তবে তোমার বন্ধুই তোমার শত্রু। এখন আমি তোমাকে খাব।”
হরিণটি কান্না করতে লাগল। এমন সময় বনের রাজা সিংহ এসে উপস্থিত হল। সে সব শুনে শিয়ালকে শাস্তি দিল এবং হরিণকে মুক্ত করে দিল।
গল্পের শিক্ষা:
সবার সাথে বন্ধুত্ব করার আগে তার স্বভাব বুঝে নেওয়া উচিত। মিষ্টি কথায় বিশ্বাস করলে অনেক সময় বিপদ হতে পারে।
হাতি আর শিয়ালের গল্প
এক জঙ্গলে বাস করত এক বিশাল হাতি। সে ছিল শান্ত, শক্তিশালী আর দয়ালু। বনের সব প্রাণী তাকে সম্মান করত। কিন্তু একটি শিয়াল ছিল, যে হাতির এই সম্মান সহ্য করতে পারত না। সে খুব ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছিল।
একদিন শিয়াল নিজের মনে ভাবল:
“এই বিশাল হাতিকে যদি কোনোভাবে অপদস্থ করা যায়, তাহলে আমি হবো বনের সবচেয়ে চতুর প্রাণী হিসেবে পরিচিত।”
সে এক ছলনা ভাবল। শিয়ালটি এক জায়গায় গর্ত খুঁড়ে রাখল এবং সেটি পাতা ও ডাল দিয়ে ঢেকে দিল। এরপর সে হাতির কাছে গিয়ে বলল,
— “হাতি ভাই, পাশের পাহাড়ের ওপারে একটি বড় ফলের বাগান আছে। তুমি চাইলে আমি তোমায় সেখানে নিয়ে যেতে পারি।”
হাতি নিরীহভাবে বলল,
— “তুমি এত ভালো! চল, আমাকে দেখিয়ে নিয়ে চলো।”
শিয়াল হাতিকে গর্তের দিকে নিয়ে গেল। হাতি কিছু বুঝে ওঠার আগেই পা পিছলে সেই গর্তে পড়ে গেল। গর্ত বেশ গভীর হওয়ায় সে আর বেরোতে পারছিল না।
শব্দ শুনে বনের অন্যান্য প্রাণীরা ছুটে এলো। তারা হাতিকে গর্ত থেকে বের করে আনতে সাহায্য করল। সব শুনে সিংহ রাজা রেগে গিয়ে শিয়ালকে ডেকে পাঠাল।
— “তুমি একজন নিরীহ প্রাণীর ক্ষতি করতে চেয়েছো হিংসার কারণে? এই জঙ্গল সে জন্য নয়। এখন থেকে তুমি বনের পাশে থাকবে, কাউকে ঠকানোর সুযোগ পাবে না।”
শিয়াল অপদস্থ হয়ে লজ্জিত হল, আর হাতি তার দয়ালু মনোভাবের কারণে আবার সবার শ্রদ্ধা অর্জন করল।
গল্পের শিক্ষা:
অন্যের সাফল্যে হিংসা করা উচিত নয়। হিংসা করলে নিজেরই ক্ষতি হয়। বরং অন্যের ভালো কাজ দেখে উৎসাহিত হওয়া ভালো।
বোকা শিয়ালের গল্প
এক গ্রামে পাশের জঙ্গলে এক বোকা শিয়াল বাস করত। সে নিজেকে খুব চালাক ভাবত, কিন্তু আসলে ছিল বেশ গাঁইয়া আর অল্প জ্ঞানের। তার বিশ্বাস ছিল সে যেকোনো প্রাণীকে ঠকাতে পারে।
একদিন সে শুনল এক গাছে মৌচাক তৈরি হয়েছে, আর সেই মৌচাকে অনেক মধু! শিয়াল মধু খাওয়ার লোভে গাছে উঠল—যেটা সে কোনোদিন করে না।
গাছে উঠতে গিয়ে সে বারবার পিছলে পড়তে লাগল। তারপর কীভাবে যেন এক ডালে উঠে গেল। এবার সে মধু খেতে শুরু করল। কিন্তু হঠাৎ করে মৌমাছিরা এসে গেল!
মৌমাছির দল রেগে গিয়ে শিয়ালকে কামড়াতে শুরু করল। শিয়াল ভয়ে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গেল—ডাল ভেঙে তার মাথায় পড়ল আর পিঠে ব্যথা পেল। সে দৌড়ে পালিয়ে গেল জঙ্গল থেকে।
পথে এক খরগোশ জিজ্ঞেস করল,
— “কি রে শিয়াল ভাই, এত কষ্টে কেন?”
শিয়াল বলল,
— “ভাইরে, চালাক না হয়ে সোজা থাকলেই ভালো ছিল! এখন বুঝি, যা জানি না সেটা না করাই ভালো!”
গল্পের শিক্ষা:
নিজেকে বেশি চালাক ভাবলে বিপদ হতে পারে। অযথা লোভ বা অহংকার করলে নিজেরই ক্ষতি হয়।
হাঁস ও শিয়ালের গল্প
একটা নদীর ধারে সুন্দর এক গ্রামে এক হাঁস পরিবার থাকত। তারা ছিল বেশ মজার, পরিশ্রমী এবং নিজেদের মতো করে জীবন কাটাত। প্রতিদিন সকালে হাঁসেরা নদীতে সাঁতার কাটত, আর সন্ধ্যায় ফিরত তাদের ছোট্ট ঘরে।
বনের এক শিয়াল এসব দেখে ভাবল:
“এই হাঁসগুলো তো বেশ মোটা টিকটিক, এদের একজনকে ধরতে পারলে এক বেলার মজাদার খাবার হয়ে যাবে!”
শিয়ালের ছলনা
শিয়াল একদিন হাঁসদের পাশে এসে বলল,
— “হাঁস ভাইবোনেরা, আমি এখন বদলে গেছি। আমি আর কোনো প্রাণীকে খাই না। আমি শুধু বন্ধু হতে চাই।”
হাঁসেরা প্রথমে সন্দেহ করল, কিন্তু শিয়ালের মিষ্টি কথায় ধীরে ধীরে বিশ্বাস করে ফেলল। তারপর একদিন শিয়াল হাঁসদের বলল,
— “চলো, আমি তোমাদের জন্য একটা দারুণ জায়গা দেখাব, যেখানে পানি পরিষ্কার, আর খাবারও প্রচুর!”
একটা সাহসী হাঁস বলল,
— “তুমি আগে যাও, আমরা পেছনে আসছি।”
শিয়াল সামনে সামনে চলতে লাগল, আর হাঁসেরা দূর থেকে অনুসরণ করল।
বিপদের মুখে শিয়াল
শিয়াল হাঁসদের একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে এল, যেখানে সে আগে থেকে ফাঁদ তৈরি করেছিল। কিন্তু শিয়াল বুঝতেই পারেনি, সেই ফাঁদে আগেই একটি শিকারির বড়ো জাল পাতা ছিল। হঠাৎ সে নিজেই জালে আটকে গেল!
হাঁসেরা দূর থেকে সব দেখল। তারা বুঝতে পারল শিয়াল কতটা ছলনাকারী।
সাহসী হাঁসটি বলল,
— “দেখো! যারা অন্যকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে, তারা নিজেরাই ফাঁদে পড়ে যায়!”
গল্পের শিক্ষা:
ছলনাকারী শেষ পর্যন্ত নিজেরই ক্ষতি করে।
অপরিচিতদের মিষ্টি কথায় সবসময় বিশ্বাস করা ঠিক নয়।
সিংহ ও শিয়ালের গল্প
এক গভীর জঙ্গলে বাস করত এক গর্বিত সিংহ। সে ছিল বনের রাজা। তার হুংকারে বনের সব প্রাণী কাঁপত। আর ছিল এক চতুর শিয়াল, যে ছিল দুর্বল, কিন্তু খুব বুদ্ধিমান।
সিংহ প্রতিদিন শিকার করত, কিন্তু সে একা সব খেতে পারত না। একদিন শিয়াল সিংহকে বলল,
— “মহারাজ, আপনি যদি চান, আমি আপনার সহকারী হতে পারি। আমি শিকার খুঁজে দিতে পারি, পথ দেখাতে পারি।”
সিংহ ভাবল:
“ঠিকই তো! এতে আমার কষ্ট কম হবে।”
শিয়াল এখন সিংহের সাথে ঘুরত, কিন্তু নিজে কিছু না করেই সব সময় শেয়ারে অংশ পেত।
অন্যায়ের প্রতিবাদ
একদিন, সিংহ একটি হরিণ শিকার করল। শিয়াল যথারীতি অংশ চাইতে গেল। কিন্তু সিংহ হঠাৎ রেগে গিয়ে গর্জে উঠল:
— “তুই কিছুই করিস না, শুধু খেতে আসিস! আজ তোকে কোনো মাংসই দেব না!”
শিয়াল খুব কষ্ট পেল, কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে বলল:
— “মহারাজ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনি রাজা, আপনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে যদি আপনি নিজে শিকার করেই সব খান, তাহলে আপনি একা হয়ে যাবেন। একদিন আপনার পাশে কেউ থাকবে না।”
সিংহ একটু থমকে গেল। ভাবল, সত্যিই তো—রাজা হলেও একা কিছুই করা যায় না।
পরিবর্তনের শুরু
সিংহ বুঝল, শিয়াল শুধু খেতে আসত না, সে পথ দেখাত, বিপদ এড়াতে সাহায্য করত। এরপর থেকে সিংহ সবার সাথে সম্মান দিয়ে আচরণ করতে শুরু করল। শিয়ালও খুশি মনে তার সাহায্য চালিয়ে গেল।
গল্পের শিক্ষা:
ক্ষমতা থাকলেই কাউকে অবজ্ঞা করা ঠিক নয়।
সহযোগিতার মনোভাবই একজনকে সত্যিকারের নেতা করে তোলে।
উপসংহার
শিয়ালের গল্পগুলো কেবল গল্প বলার উপকরণ নয়—বরং প্রতিটি গল্পের শেষে লুকিয়ে থাকে একটি শিক্ষণীয় বার্তা, যা শিশুদের চারিত্রিক গঠন ও নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। শিয়ালের চালাকি যেমন আনন্দ দেয়, তেমনি গল্পের শেষে প্রতিফলনের মাধ্যমে শেখায়—অহংকার, লোভ ও প্রতারণার পরিণতি কী হতে পারে। তাই বাংলা রূপকথা ও লোককাহিনিতে শিয়াল একটি চিরচেনা চরিত্র, যা আজও গল্পপ্রেমীদের মনে বিশেষ স্থান ধরে রেখেছে। আপনি যদি শিশুদের জন্য মজার অথচ শিক্ষামূলক গল্প খুঁজে থাকেন, তবে শিয়ালের গল্প একটি আদর্শ পছন্দ হতে পারে।

