“বিদ্রোহী” কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী ভাবধারার এক অনবদ্য প্রকাশ। এখানে কবি শুধু সামাজিক শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলেননি, বরং তাঁর আত্মার উচ্চতর “উন্নত শির”-এর অভিজ্ঞতা, মানব-মূল্য ও মুক্তির সপক্ষে এক অভ্যুত্থান উৎসব হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। লেখাটি এই কবিতার গভীরতা, তার ভাব-প্রকাশ ও প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করবে — যাতে পাঠক শুধু কবিতাটি পড়ে শেষ করে না, বরং তার গভীরে প্রবেশ করতে পারে।
এখানে আপনি পাবেন:
বিদ্রোহী কবিতার পূর্ণ পাঠ
বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি,
নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর –
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর –
আমি চির-উন্নত শির!
আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
আমি দুর্ব্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!
আমি মানি নাকো কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বল বীর –
চির উন্নত মম শির!
আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী,
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী!
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠুমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দিই তিন দোল্!
আমি চপলা-চপল হিন্দোল!
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।
বল বীর –
আমি চির-উন্নত শির!
আমি চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ,
আমি দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম ভরপুর মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য,
মম এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য।
আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর –
চির উন্নত মম শির।
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক!
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!
আমি প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি কভু প্রশান্ত, – কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী!
আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল!
আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি।
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর!
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের!
আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত-চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্।
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া!
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি,
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! –
আমি তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন!
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে,
তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি’ ভূমি-কম্প!
ধরি বাসুকির ফনা জাপটি’, –
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’!
আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্ ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্
মম বাঁশরী তানে পাশরি’
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠে’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি শ্রাবণ প্লাবন- বন্যা, কভু ধরণীরে করি বরণিয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা –
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়, জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম স্কন্ধে,
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর –
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
বিদ্রোহী কবিতার মূলভাব
কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” কবিতাটি একটি অদম্য বিদ্রোহের মহাকাব্য, যার মূলভাবকে এক কথায় বলা যায়:
“আমি চির-উন্নত শিরের বিদ্রোহী — অত্যাচার, অন্যায় ও বন্ধনের বিরুদ্ধে ধ্বংস ও সৃষ্টির দ্বৈতশক্তি নিয়ে মানবতার মুক্তির জন্য যুদ্ধ করি, আর শান্তি পাবো কেবল তখনই, যখন পৃথিবী থেকে উৎপীড়নের শেষ কান্না মুছে যাবে।”
মূলভাবের বিস্তারিত বিশ্লেষণ (৫টি কেন্দ্রীয় স্তম্ভ)
| স্তম্ভ | ব্যাখ্যা | কবিতা থেকে উদাহরণ |
|---|---|---|
| ১. চির-উন্নত শিরের গর্ব ও স্বাধীনতা | কবি নিজেকে কোনো শক্তির কাছে নত না হওয়া, স্বাধীন ও অহংকারী আত্মা হিসেবে দেখান। | “বল বীর— চির উন্নত মম শির!” (প্রতিটি স্তবকে পুনরাবৃত্তি) |
| ২. ধ্বংসের মাধ্যমে মুক্তি | অন্যায়, শৃঙ্খলা, আইন-কানুন — সব বন্ধন ভেঙে ধ্বংস করাই বিদ্রোহের পথ। | “আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!” |
| ৩. সৃষ্টি ও ধ্বংসের দ্বৈত রূপ | বিদ্রোহী কেবল ধ্বংস করে না, সে নতুন সৃষ্টির জন্য পুরোনোকে ধ্বংস করে। | “আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান” |
| ৪. সার্বজনীন ও মানবিক বিদ্রোহ | এ বিদ্রোহ ব্যক্তিগত নয় — এটি উৎপীড়িত, অবহেলিত, বঞ্চিত সকলের পক্ষে। | “আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের” |
| ৫. শান্তির শর্তাধীন প্রতিশ্রুতি | বিদ্রোহী শান্তি চায়, কিন্তু তা পাবে কেবল অত্যাচারের সম্পূর্ণ অবসানের পর। | “যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না… আমি সেই দিন হব শান্ত!” |
এক লাইনে মূলভাব:
“অন্যায়ের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক সৃজনশীল বিদ্রোহের মাধ্যমে মানবতার চির-উন্নত মুক্তি ও শান্তি অর্জন।”
অতিরিক্ত দ্রষ্টব্য:
- কবিতায় হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সকল মিথ ও প্রতীকের সমন্বয় — যা বিদ্রোহকে সার্বজনীন ও ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলে।
- “আমি” শব্দটি ১৫০+ বার ব্যবহৃত — এটি ব্যক্তি থেকে সমষ্টির প্রতিনিধিত্ব করে।
সারকথা: বিদ্রোহী কোনো ক্ষণিকের রাগ নয় — এটি মানবতার চিরন্তন মুক্তি-সংগ্রামের দলিল।
বিদ্রোহী কবিতা ব্যাখ্যা
কাজী নজরুল ইসলাম (স্তবক-ভিত্তিক বিশ্লেষণ, প্রতীক-অর্থ, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ভাষা-বিশ্লেষণ সহ)
পরিচিতি ও সাধারণ ব্যাখ্যা
“বিদ্রোহী” (১৯২১) নজরুলের বিপ্লবী চেতনার মহাকাব্য।
- মূল সুর: অত্যাচারের বিরুদ্ধে অদম্য বিদ্রোহ, ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টি এবং উৎপীড়িত মানবতার মুক্তি।
- ফর্ম: মুক্ত ছন্দ (Free Verse) কিন্তু অভ্যন্তরীণ তাল ও লয়ে বাঁধা।
- প্রতীক: “আমি” = ব্যক্তি + সমষ্টি + বিশ্ব-চেতনা।
- প্রেক্ষাপট: ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, নন-কো-অপারেশন আন্দোলন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের স্বপ্ন।
স্তবক-ভিত্তিক ব্যাখ্যা
| স্তবক | মূল লাইন | ব্যাখ্যা |
|---|---|---|
| ১ | বল বীর— উন্নত মম শির! | আহ্বান: বিদ্রোহের ঘোষণা। “শির নেহারি আমারি” → হিমালয়ের মতো অটল গর্ব। “খোদার আরশ ছেদিয়া” → ঈশ্বরের সিংহাসন পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ। |
| ২ | আমি চিরদুর্দম, নৃশংস… নটরাজ, সাইক্লোন | ধ্বংসের রূপ: শিবের নটরাজ (মহাপ্রলয়ের নৃত্য), ঝড়, ধ্বংস — পুরোনো ব্যবস্থা ভাঙার প্রতীক। |
| ৩ | আমি দ’লে যাই যত বন্ধন… টর্পেডো, ভাসমান মাইন | বিপ্লবী অস্ত্র: আইন, শৃঙ্খলা, সমাজের বেড়াজাল ভাঙা। “ভরা-তরী ডুবি” → অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে। |
| ৪ | আমি ঝঞ্ঝা… মুক্ত জীবনানন্দ | আনন্দময় বিদ্রোহ: ধ্বংস নয়, মুক্তির উল্লাস। রাগ-রাগিণীর উল্লেখ → সঙ্গীতের মাধ্যমে বিপ্লব। |
| ৫ | শত্রুর সাথে গলাগলি, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা | অদম্য সাহস: শত্রুকে আলিঙ্গন (মানবতাবাদী বিদ্রোহ), মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ। |
| ৬ | আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস… বাঁশরী, রণ-তূর্য্য | দ্বৈত রূপ: কৃষ্ণের বাঁশরী (প্রেম) + যুদ্ধের তূর্য (সংগ্রাম)। |
| ৭ | আমি বেদুঈন, চেঙ্গিস… ওঙ্কার, ইস্ত্রাফিল | সার্বজনীনতা: হিন্দু (ওঙ্কার), ইসলাম (ইস্ত্রাফিল), মঙ্গোল (চেঙ্গিস) — ধর্ম-জাতি-সীমা অতিক্রম। |
| ৮ | আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী… প্রথম পরশ কুমারীর | নারী-মুক্তি: বন্ধনমুক্ত নারী, প্রেমের স্বাধীনতা, যৌনতার স্বাভাবিকতা। |
| ৯ | আমি বিধবার ক্রন্দন… পথিকের বঞ্চিত ব্যথা | সামাজিক বিদ্রোহ: বিধবা, পথিক, অবমানিত — সকল শ্রেণির বেদনার প্রতিনিধি। |
| ১০ | আমি তড়িতে চড়িয়া… জিব্রাইলের পাখা | মহাকাশীয় বিদ্রোহ: বিজ্ঞান + মিথ মিশ্রিত। |
| ১১ | আমি শ্রাবণ প্লাবন-বন্যা… ছিন্নমস্তা চন্ডী | নারীশক্তি: চন্ডী, কালী — ধ্বংসকারী মাতৃশক্তি। |
| ১২ | আমি মৃণ্ময়, চিন্ময়… পুরুষোত্তম সত্য | দার্শনিক উচ্চতা: মাটি (মানব) + চেতনা (ঈশ্বর) — মানবই ঈশ্বর। |
| ১৩ | আমি পরশুরামের কুঠার… নিঃক্ষত্রিয় করিব | সামাজিক বিপ্লব: ক্ষত্রিয় (শাসক) শ্রেণি ধ্বংস করে সমতা। |
| ১৪ | মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত… আমি সেই দিন হব শান্ত | শান্তির শর্ত: উৎপীড়ন শেষ হলেই শান্তি। |
| ১৫ | আমি বিদ্রোহী ভৃগু… বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন | ঈশ্বরের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ: ভৃগু ঈশ্বরের বুকে লাথি মারেন — বিধির অন্যায়ের বিরুদ্ধে। |
প্রতীক-সম্ভার
| প্রতীক | অর্থ |
|---|---|
| শির | গর্ব, স্বাধীনতা, অটলতা |
| ঝড়, ঘূর্ণি, সাইক্লোন | বিপ্লবী শক্তি |
| বাঁশরী | প্রেম, সৌন্দর্য, কৃষ্ণ |
| রণ-তূর্য্য | যুদ্ধ, সংগ্রাম |
| নটরাজ | শিব — সৃষ্টি-ধ্বংসের চক্র |
| আরশ | ঈশ্বরের সিংহাসন — সর্বোচ্চ ক্ষমতা |
| পরশুরাম | ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকবিরোধী |
| ভৃগু | ঋষি যিনি বিষ্ণুর বুকে লাথি মারেন |
ভাষা ও শৈলী
- “আমি” → ১৫০+ বার → আত্ম-ঘোষণা + সমষ্টি-চেতনা
- সংস্কৃত-ফারসি-আরবি-ইংরেজি শব্দের মিশ্রণ → হিন্দু-মুসলিম ঐক্য
- ধ্বনি-অনুকরণ: “ঝঞ্ঝা”, “চুরমার”, “ফিং”, “ঝর-ঝর” → গতি ও শক্তি
- বিপরীতার্থক শব্দ: সৃষ্টি-ধ্বংস, প্রশান্ত-অশান্ত → দ্বন্দ্বের দর্শন
ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রভাব
| ক্ষেত্র | প্রভাব |
|---|---|
| স্বাধীনতা আন্দোলন | ব্রিটিশ সরকার নজরুলকে গ্রেপ্তার করে (১৯২২) |
| নারী-মুক্তি | বিধবা, কুমারী, চন্ডীর উল্লেখ → নারীশক্তির জাগরণ |
| ধর্মীয় সমন্বয় | হিন্দু-মুসলিম প্রতীকের মিশ্রণ → সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি |
| আধুনিকতা | ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে গাওয়া হয়েছে, আজও প্রতিবাদে ব্যবহৃত |
উপসংহার
“বিদ্রোহী” কোনো কবিতা নয় — এ এক বিপ্লবী মন্ত্র। এটি শুধু কলোনিয়াল শাসনের বিরুদ্ধে নয়, প্রতিটি অন্যায়, অসমতা ও বন্ধনের বিরুদ্ধে এক অমর ঘোষণাপত্র।
মূল বার্তা:
“যতক্ষণ উৎপীড়ন আছে, ততক্ষণ বিদ্রোহ থাকবে। শান্তি আসবে — কেবল সম্পূর্ণ মুক্তির পর।”
পঠনের জন্য প্রস্তাবিত: প্রতিটি স্তবক জোরে জোরে পড়ুন — ছন্দ ও শক্তি নিজেই অনুভূত হবে।
“আমি চির-বিদ্রোহী বীর — আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!”
বিদ্রোহী কবিতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯২১ সালে লেখা “বিদ্রোহী” কবিতাটি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রচিত। এটি নন-কো-অপারেশন মুভমেন্টের সমকালীন, যখন গান্ধীজির নেতৃত্বে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চরমে। নজরুল, যিনি সেনাবাহিনী থেকে ফিরে এসে কলকাতায় সাহিত্যিক জীবন শুরু করেন, এই কবিতায় কলোনিয়াল অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানান। কথিত আছে যে ২২ বছর বয়সে তিনি এক রাতে এই কবিতা লিখে ফেলেন। এটি প্রথমে “প্রলয়োল্লাস” নামে প্রকাশিত হয় এবং পরে “বিদ্রোহী” নামে পরিচিত হয়। কবিতাটি ব্রিটিশ সরকারকে এতটাই বিরক্ত করে যে নজরুলকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, সামাজিক অসমতার বিরুদ্ধেও একটি যুদ্ধঘোষণা।
সারাংশ ও অন্ত্যন্ত ভাবনা
“বিদ্রোহী” শুধু এক কবিতা নয় — এটি এক মনোবলে দৃপ্ত ঘোষণা, এক চেতনায় উত্তোয়ন। কাজী নজরুল ইসলাম এখানে নিজেকে এবং পাঠককে আহ্বান জানাচ্ছেন আরেক ‘উন্নত শির’ অর্জনের জন্য। যে ‘উন্নত শির’ মানে হয় স্বাধীনতা, হয় ন্যায়, হয় মানব মর্যাদা। এই কবিতার মনোবল, ভাষার তীব্রতা ও প্রতীকীর শক্তি আজও সময়োপযোগী।