ইসলামে বিবাহিত জীবন শুধু দাম্পত্য আনন্দ নয়, বরং এটি ইবাদতের অংশ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও একটি হালাল ও বরকতময় কাজ, যদি তা ইসলামি আদব মেনে করা হয়। আল্লাহ তাআলা মানুষকে দাম্পত্য জীবনের মাধ্যমে শারীরিক চাহিদা পূরণ, মানসিক প্রশান্তি এবং সন্তান উৎপাদনের সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু ইসলাম আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজে দোয়া ও আল্লাহর স্মরণ রাখতে শিক্ষা দিয়েছে।
সহবাসের আগে একটি নির্দিষ্ট দোয়া রয়েছে যা সহিহ হাদিসে প্রমাণিত। এটি পড়ে সহবাস করলে স্বামী-স্ত্রী শয়তানের অনিষ্ট থেকে সুরক্ষিত থাকে এবং সন্তান জন্মালে সেই সন্তানও শয়তানের প্রভাব থেকে নিরাপদ থাকে। এই আর্টিকেলে আমরা সহবাসের দোয়া, এর উপকারিতা, সহবাসের আদব, হারাম কাজ এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর আলোচনা করব।
এখানে আপনি পাবেন:
সহবাসের আগে দোয়া
আরবি:
بِسْمِ اللَّهِ، اللَّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ، وَجَنِّبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا
বাংলা উচ্চারণ:
বিসমিল্লাহ, আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শাইতানা, ওয়া জান্নিবিশ শাইতানা মা রাযাকতানা।
অর্থ:
আল্লাহর নামে শুরু করছি। হে আল্লাহ! আমাদেরকে শয়তান থেকে দূরে রাখুন এবং আপনি আমাদের যা সন্তানের রূপে দান করবেন, তাকে শয়তান থেকে দূরে রাখুন।
রেফারেন্স:
- সহিহ বুখারি: হাদিস ৩২৭১
- সহিহ মুসলিম: হাদিস ১৪৩৪
রাসূলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم বলেছেন —
যদি তোমাদের কেউ সহবাস করার সময় এই দোয়া পড়ে এবং সেই মিলন থেকে সন্তান জন্ম নেয়, তবে শয়তান কখনো তাকে ক্ষতি করতে পারবে না।
দোয়ার প্রেক্ষাপট
রাসূলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم তাঁর উম্মতকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর স্মরণ রাখার শিক্ষা দিয়েছেন। এমনকি দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তেও আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে কাজটি শুধু শারীরিক আনন্দ নয়, বরং বরকতময় ইবাদতে পরিণত হয়। সহবাসের আগে এই দোয়া পড়া মূলত শয়তানের প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং সন্তানকে আধ্যাত্মিক সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
সহবাসের আগে দোয়া পড়ার উপকারিতা
- শয়তানের প্রভাব থেকে সুরক্ষা
সহবাসের সময় শয়তান স্বামী-স্ত্রীর মাঝে প্রবেশ করে, যদি তারা আল্লাহর নাম না নেয়। এই দোয়া শয়তানের প্রবেশ ও প্রভাবকে প্রতিহত করে। - সন্তানকে আধ্যাত্মিক সুরক্ষা
সহিহ হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে—যদি দোয়া পড়ে সহবাস করা হয় এবং সন্তান জন্ম নেয়, শয়তান তার ক্ষতি করতে পারবে না। - কাজকে ইবাদতে রূপান্তর
ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে হালাল সহবাস ইবাদত, এবং দোয়া পড়ে শুরু করলে এটি সওয়াবের কাজ হয়ে যায়। - মনোসংযোগ ও ইতিবাচক মানসিকতা
আল্লাহর নাম নিয়ে কাজ শুরু করলে মন শান্ত থাকে এবং সম্পর্ক আরও পবিত্র হয়।
সহবাসের ইসলামি আদব (বিস্তারিত)
সহবাসের আগে ও পরে কিছু আদব ও নিয়ম মেনে চলা উচিত। এগুলো কেবল আধ্যাত্মিক উপকারই নয়, বরং দাম্পত্য সম্পর্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
- দোয়া পড়া — সহবাস শুরুর আগে নির্দিষ্ট দোয়া পড়া।
- গোপনীয়তা বজায় রাখা — অন্যের সামনে বা শিশুদের উপস্থিতিতে সহবাস করা হারাম।
- উভয়ের সম্মতি — স্বামী-স্ত্রী উভয়ের শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিশ্চিত করা।
- পবিত্রতা — পরিচ্ছন্ন পোশাক ও সুগন্ধি ব্যবহার করা।
- স্নেহপূর্ণ আচরণ — সহবাসের আগে মিষ্টি কথা, আদর, ও আলিঙ্গন করা।
- অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো না করা — স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা।
- নিষিদ্ধ অবস্থায় সহবাস না করা — স্ত্রী মাসিক বা প্রসব-পরবর্তী রক্তস্রাবের সময় সহবাস করা হারাম।
- হারাম পদ্ধতি বর্জন — পেছনের রাস্তা দিয়ে সহবাস করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
- মদ্যপান বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সহবাস না করা।
- পরবর্তী সময়ে পরস্পরের খেয়াল রাখা — সহবাসের পর স্নেহপূর্ণ আচরণ করা।
সহবাসের পরে করণীয়
- গোসল ফরজ — সহবাসের পর ফরজ গোসল করতে হবে।
- আল্লাহর শুকরিয়া আদায় — দাম্পত্য জীবনের হালাল আনন্দের জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
- তাহারাত ছাড়া ঘুম না যাওয়া — যদি সাথে সাথে গোসল করা সম্ভব না হয়, তবে ওজু করে ঘুমানো।
সহবাসে হারাম ও অপছন্দনীয় কাজ
- মাসিক ও নিফাসের সময় সহবাস — কুরআন (সূরা বাকারা ২:২২২) দ্বারা নিষিদ্ধ।
- পেছনের রাস্তা দিয়ে সহবাস — সহিহ হাদিসে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
- অশ্লীল ভাষা ও আচরণ — যা দাম্পত্য সম্পর্কের মর্যাদা নষ্ট করে।
- অন্যের সাথে তুলনা বা কল্পনা করা — যা অন্তরে সন্দেহ ও ঘৃণা তৈরি করে।
- প্রকাশ্যে বা আংশিক উন্মুক্ত অবস্থায় সহবাস — ইসলামে গোপনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
দোয়া ভুলে গেলে কী হবে?
সহবাসের সময় দোয়া পড়া সুন্নত। ভুলে গেলে গুনাহ হবে না, তবে অভ্যাস করার চেষ্টা করা উচিত।
স্ত্রী কি দোয়া পড়তে পারবে?
হ্যাঁ, স্বামী-স্ত্রী উভয়েই নীরবে বা মনে মনে পড়তে পারে।
বিয়ের আগে এই দোয়া কি পড়া যায়?
না, কারণ সহবাস কেবল হালাল বিবাহিত সম্পর্কেই বৈধ।
দোয়া কি বাংলায় পড়া যাবে?
দোয়া আরবিতে পড়া উত্তম। তবে অর্থ মনে রেখে বাংলায় বললেও আল্লাহ কবুল করতে পারেন, তবে হাদিসের ভাষা অনুসরণই শ্রেয়।
উপসংহার
সহবাসের আগে দোয়া পড়া একটি ছোট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল। এটি শয়তানের প্রভাব থেকে রক্ষা করে, সন্তানকে আধ্যাত্মিক সুরক্ষা দেয় এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে বরকতময় করে তোলে। ইসলামের প্রতিটি নির্দেশনা যেমন কল্যাণময়, তেমনি দাম্পত্য জীবনের এই ছোট দোয়াও আমাদের জীবনে অসীম শান্তি ও নিরাপত্তা আনতে পারে। তাই প্রত্যেক মুসলিম দম্পতিরই উচিত এই দোয়াটি মুখস্থ রাখা এবং জীবনে নিয়মিত আমল করা।

