ইস্তেখারার দোয়া — সহিহ হাদিসের আলোকে পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা

জীবনে এমন অনেক সময় আসে, যখন আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় পড়ে যাই—চাকরি, ব্যবসা, বিবাহ, ভ্রমণ বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ইসলামে এমন অবস্থায় আল্লাহর কাছ থেকে সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য দিকনির্দেশনা চাওয়ার একটি বিশেষ নামাজ ও দোয়া রয়েছে, যার নাম সালাতুল ইস্তেখারা

ইস্তেখারা মানে “কল্যাণ চাওয়া”। এটি রাসূলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم তাঁর সাহাবাদের শিখিয়েছিলেন যেমনভাবে কুরআনের একটি সূরা শেখাতেন। সহিহ হাদিসে ইস্তেখারার দোয়া ও এর পদ্ধতি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।


ইস্তেখারা কী?

ইস্তেখারা হলো আল্লাহর কাছে এমন সিদ্ধান্ত চাওয়া যাতে কল্যাণ আছে এবং ক্ষতি থেকে বাঁচা যায়। এটি কোনো স্বপ্ন দেখার পদ্ধতি নয়, বরং আল্লাহর কাছে সঠিক পথের জন্য দোয়া করার একটি আমল।


ইস্তেখারার গুরুত্ব

  • জীবনের বড় বা ছোট যেকোনো সিদ্ধান্তে আল্লাহর সাহায্য নেওয়া।
  • নিজের সীমিত জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি স্বীকার করে আল্লাহর অসীম জ্ঞানের ওপর নির্ভর করা।
  • মানসিক প্রশান্তি ও সিদ্ধান্তে দৃঢ়তা লাভ।
  • ভুল সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা কমে যাওয়া।

ইস্তেখারার সহিহ দোয়া

আরবি:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ، وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ العَظِيمِ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ، وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ، وَأَنْتَ عَلَّامُ الغُيُوبِ، اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي، أَوْ قَالَ عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ، فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي، ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ، وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي، أَوْ قَالَ فِي عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ، فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ، وَاقْدُرْ لِيَ الخَيْرَ حَيْثُ كَانَ، ثُمَّ أَرْضِنِي

বাংলা উচ্চারণ:
আল্লাহুম্মা ইন্নি আসতাখীরুকা বি’ইলমিক, ওয়া আসতাকদিরুকা বি-কুদরাতিক, ওয়া আসআলুকা মিন ফাদলিকাল আযীম, ফা’ইন্নাকা তাকদিরু ওয়ালা আকদিরু, ওয়া তা’আলামু ওয়ালা আ’আলামু, ওয়া আন্তা আল্লামুল-গুইউব। আল্লা-হুম্মা ইন্না কুন্তা তা’আলামু আন্না হাজাল-আমরা খাইরুল্লি ফি দীনি ওয়া মা’আশি ওয়া আ’কিবাতি আমরি (আউ ক্বালা আ’জিলি আমরি ওয়া আ’জিলিহি), ফাকদুরহু লি ওয়া ইয়াসসিরহু লি, সুম্মা বারিক লি ফিহি। ওয়া ইন্না কুন্তা তা’আলামু আন্না হাজাল-আমরা শাররুল্লি ফি দীনি ওয়া মা’আশি ওয়া আ’কিবাতি আমরি (আউ ক্বালা ফি আ’জিলি আমরি ওয়া আ’জিলিহি), ফাসরিফহু আন্নি ওয়াসরিফনি আনহু, ওয়াকদুর লি আল-খাইরা হাইসূ কানা, সুম্মা আরদ্বিনি।

অর্থ:
হে আল্লাহ! আমি আপনার জ্ঞানের দ্বারা আপনার কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করছি এবং আপনার ক্ষমতার দ্বারা শক্তি চাইছি এবং আপনার মহান অনুগ্রহ থেকে প্রার্থনা করছি। নিশ্চয়ই আপনি পারেন, আমি পারি না; আপনি জানেন, আমি জানি না; আর আপনি অদৃশ্য বিষয়সমূহের সর্বজ্ঞ। হে আল্লাহ! আপনি যদি জানেন যে, এই কাজটি আমার দ্বীন, আমার জীবনযাপন এবং আমার পরিণতির জন্য কল্যাণকর (অথবা বললেন—আমার বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য), তবে আপনি এটি আমার জন্য নির্ধারণ করুন, সহজ করে দিন এবং এতে বরকত দিন। আর আপনি যদি জানেন যে, এই কাজটি আমার দ্বীন, আমার জীবনযাপন এবং আমার পরিণতির জন্য ক্ষতিকর (অথবা আমার বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য), তবে এটিকে আমার থেকে দূরে রাখুন এবং আমাকে তা থেকে দূরে রাখুন, আর যেখানে কল্যাণ আছে সেটি আমার জন্য নির্ধারণ করুন, তারপর আমাকে এতে সন্তুষ্ট করুন।

রেফারেন্স:
সহিহ বুখারি: হাদিস ১১৬২


ইস্তেখারার নামাজের পদ্ধতি

  1. ওজু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া।
  2. প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা ইখলাস পড়া উত্তম।
  3. সালাম ফেরানোর পর উল্লিখিত ইস্তেখারার দোয়া পড়া।
  4. “হাজাল আমর” অংশে প্রয়োজনীয় কাজ বা বিষয় মনে করা বা নাম উল্লেখ করা।

ইস্তেখারার সময় ও নিয়ম

  • ইস্তেখারা যেকোনো সময় করা যায়, তবে নামাজের নিষিদ্ধ সময়ে নয়।
  • প্রয়োজনে কয়েকদিন ধারাবাহিকভাবে ইস্তেখারা করা যেতে পারে।
  • সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বা বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ইস্তেখারা করা উত্তম।

ইস্তেখারার ফলাফল কীভাবে বুঝবেন?

  • ইস্তেখারা করার পর অন্তরে শান্তি ও দৃঢ়তা অনুভূত হলে বুঝবেন সিদ্ধান্তটি কল্যাণকর।
  • অস্বস্তি বা অশান্তি থাকলে সেই কাজ থেকে বিরত থাকা ভালো।
  • স্বপ্ন দেখা ইস্তেখারার শর্ত নয়।

ইস্তেখারা নিয়ে সাধারণ ভুল ধারণা

  1. শুধু স্বপ্ন দেখার জন্য ইস্তেখারা করা।
  2. অন্য কাউকে দিয়ে নিজের হয়ে ইস্তেখারা করানো (এটি বিদআত)।
  3. সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পর ইস্তেখারা করা।
  4. শুধু দোয়া না করে নামাজ বাদ দেওয়া।

ইস্তেখারা সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)

ইস্তেখারার দোয়া কি বাংলায় পড়া যাবে?

মূল আরবিতে পড়া উত্তম, তবে অর্থ মনে রেখে বাংলায় দোয়া করা যাবে।

প্রতিটি ছোট কাজের জন্য ইস্তেখারা করা কি জরুরি?

খুব ছোট ও সাধারণ কাজের জন্য জরুরি নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে করা উত্তম।

ইস্তেখারা করার পর মন খারাপ হলে কী করব?

সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকাই ভালো, কারণ সেটি আপনার জন্য কল্যাণকর নয়।


উপসংহার

ইস্তেখারা হলো জীবনের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে কল্যাণ চাওয়ার একটি বরকতময় আমল। এটি শুধুমাত্র দোয়া নয়, বরং আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসার প্রকাশ। জীবনের বড় বা ছোট যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সালাতুল ইস্তেখারা আদায় করলে ইনশাআল্লাহ কল্যাণের পথ সহজ হবে এবং ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

মাওলানা ফাহিমুদ্দীন আল কাসেমী

মাওলানা ফাহিমুদ্দীন আল কাসেমী একজন প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার ও লেখক, যিনি দীর্ঘদিন ধরে কুরআন-হাদীসভিত্তিক দোয়া, আমল ও ইসলামিক জীবনদর্শন নিয়ে লেখালেখি করে আসছেন। তিনি মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর সান্নিধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে বিশুদ্ধ সূত্রভিত্তিক দোয়া এবং আত্মিক উন্নতির পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাঁর লেখা প্রতিটি দোয়া দলিলসমৃদ্ধ, বাস্তবভিত্তিক এবং সহজবোধ্য ভাষায় উপস্থাপিত, যেন পাঠক সহজেই আমলে নিতে পারেন। তিনি বিশ্বাস করেন – “প্রত্যেক হৃদয়ের একমাত্র পরিপূর্ণ প্রশান্তি হচ্ছে আল্লাহর জিকিরে”। তাই তাঁর প্রতিটি লেখা এই লক্ষ্যে নিবেদিত যে, পাঠক যেন দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ের জন্য উপকৃত হন। লেখার বিষয়: ইসলামিক দোয়া, আমল, ফজিলত, কুরআনিক আয়াতভিত্তিক দোয়া, হাদীস থেকে সংগৃহীত দোয়া এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় দোয়া।

Leave a Comment